CKEditor 5 Sample
ঢাকা ২০ নভেম্বর, ২০২৫

আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস

#
news image

বাংলাদেশে নারীদের গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্তের হার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। বর্তমানে এই হার ১০ শতাংশ বলে সাম্প্রতিক এক তথ্য বলছে। এরমধ্যে শহরাঞ্চলে বেশি, ১১ শতাংশ। গ্রামে আবার কম, ৯ শতাংশ। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গর্ভকালীন সময়ে একজন নারীর ওজন যত বাড়ে, ডায়াবেটিসে আক্রান্তের ঝুঁকিও তত প্রকট হয়। আক্রান্তদের প্রায় অর্ধেক ভবিষ্যতে টাইপ–২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারেন এবং পরবর্তীতে শিশুদেরও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। 

সে কারণে প্রত্যেক মাতৃসেবা কেন্দ্রে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করার পরামর্শ দিচ্ছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে গিয়ে রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত বেশিরভাগ নারীই শুরুতে এ রোগের লক্ষণ সম্পর্কে ধারণা রাখতেন না। চিকিৎসকের পরামর্শে পরীক্ষা করানোর পরেই তারা জানতে পারেন।

রাজধানীর তেজগাঁওয়ের গৃহিণী মাহমুদা আক্তার বলেন, ‘প্রথম দিকে শরীর একটু দুর্বল লাগত। কিন্তু ভাবিনি ডায়াবেটিস হতে পারে। পরে পরীক্ষা করানো পর ধরা পড়ে। এখন ওষুধ খাচ্ছি এবং ডায়েট মেনে চলার চেষ্টা করছি। নিয়মিত চেকআপ না করলে হয়তো জটিলতা বাড়ত।’

আজিমপুরের বাসিন্দা রুমানা খাতুন বলছেন, ‘গর্ভাবস্থার ছয় মাসে গিয়ে জানতে পারি আমার রক্তে শর্করা বেড়েছে। চিকিৎসক বললেন, এটা নিয়ন্ত্রণে না আনলে বাচ্চার ওজন বেড়ে যেতে পারে। এখন প্রতিদিন হাঁটাচলা করি, মিষ্টিজাত খাবার পুরোপুরি বন্ধ করেছি। নিয়ম মেনে চললে ভালো থাকা যায়—এটা এখন বুঝতে পারছি।’

চিকিৎসকরা বলছেন, সচেতনতা ও সময়মতো পরীক্ষা করালে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। এতে মা ও নবজাতক অনেকটাই ঝুঁকিমুক্ত থাকে। 

সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, শহরাঞ্চলের গর্ভবতী নারীদের মধ্যে ডায়াবেটিস রোগের প্রকোপ তুলনামূলক বেশি। দ্রুত নগরায়ণ, খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন ও কম শারীরিক পরিশ্রমের ফলে এই হার প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য গবেষকরা।
‘গর্ভাবস্থায় অ্যানিমিয়া, গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ও গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপের তুলনামূলক গবেষণা’ শীর্ষক একটি গবেষণা চালিয়েছেন গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজ ও গণবিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন গবেষক। তারা হলেন- ডা. শামীমা নাসরিন শাদিয়া, ডা. আয়েশা সিদ্দিকা এবং ডা. ফারজানা আফরোজ।

গবেষণায় দেখা গেছে, ২৬ শতাংশ গর্ভবতী নারী রক্তস্বল্পতায়, ১০ শতাংশ গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে এবং ৯ শতাংশ গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। শহরাঞ্চলে গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের হার ১১ শতাংশ, যা গ্রামীণ ও আধা-শহরাঞ্চলের তুলনায় স্পষ্টতই বেশি। আক্রান্তদের ৭৬ শতাংশ নারী গৃহিণী, ১৭ শতাংশ পোশাককর্মী এবং বাকিরা অন্যান্য পেশায় যুক্ত। 

শহরাঞ্চলে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের হার বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে পরিবর্তিত জীবনযাপন, স্থবিরতা, অতিরিক্ত মানসিক চাপ এবং প্রসবকালীন বয়সের বিলম্ব। বিশেষ করে কর্মজীবী ও মধ্যবিত্ত নারীদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি। গর্ভবতী নারীদের ওজন ও রক্তে শর্করার মাত্রার মধ্যে ইতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে। অর্থাৎ শরীরের ওজন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রক্তে শর্করার মাত্রাও বেড়ে যায়।

বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাবেক গবেষক সুব্রিনা জেসমিনের ২০১৪ সালের গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের হার ছিল ৯ দশমিক ৭ শতাংশ (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী) এবং ১২ দশমিক ৯ শতাংশ (আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশনের মানদণ্ড অনুযায়ী)। সেই হিসেবে বর্তমান গবেষণায় পাওয়া ১১ শতাংশ হার নির্দেশ করছে যে, বাংলাদেশে এই রোগের বিস্তার অব্যাহতভাবে বাড়ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, গর্ভকালীন ডায়াবেটিস শুধু মায়ের নয়, নবজাতকেরও স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। এতে শিশুর স্থূলতা, জন্ম-পরবর্তী ডায়াবেটিস ও শারীরিক জটিলতার ঝুঁকি বাড়ায়। তাছাড়া মায়েরও দীর্ঘমেয়াদে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। 

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের হার নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে প্রতিটি গর্ভবতী নারীকে গর্ভধারণের প্রথম পর্যায় থেকেই নিয়মিত রক্তে শর্করা পরীক্ষা করানো জরুরি বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞারা। একইসঙ্গে সুষম খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম এবং মানসিক চাপ কমানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

এছাড়া প্রত্যেক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস পরীক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা, গর্ভবতী নারীদের জন্য সুষম খাদ্য ও আয়রন সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং প্রজনন স্বাস্থ্যসেবায় সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা জরুরি। কারণ, আগাম শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা ছাড়া এই সমস্যা ভবিষ্যতে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার বাড়াতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘গর্ভবতী মায়ের যদি ডায়াবেটিস থাকে এবং তা নিয়ন্ত্রণে না থাকে, তাহলে গর্ভস্থ শিশুর ওজন অত্যধিক বৃদ্ধি পেতে পারে, অঙ্গ-প্রতঙ্গের গঠনে সমস্যা হতে পারে, অপূর্ণাঙ্গ জন্মের সম্ভাবনা থাকে, কখনো কখনো শারীরিক ত্রুটি দেখা দিতে পারে এবং গুরুতর ক্ষেত্রে শিশুর মৃত্যুও ঘটতে পারে। তাই গর্ভবতী মায়ের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত জরুরি।

এই চিকিৎসক আরও বলেন, ‘গর্ভকালীন এই ধরনের ডায়াবেটিসকে আমরা ‘জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস’ বা গর্ভবতী মায়ের ডায়াবেটিস বলি। এটি সাধারণ সময় দেখা যায় না, তবে গর্ভধারণের সময় ধীরে ধীরে বিকাশ হয়। এই কারণে গর্ভধারণের পর থেকে সন্তান প্রসব হওয়া পর্যন্ত মায়ের নিয়মিত পরীক্ষা অত্যাবশ্যক।’

ডা. লেলিন বলেন, ‘একজন চিকিৎসক বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থেকে নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর মা এবং গর্ভস্থ শিশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। এটিই গর্ভকালীন পরীক্ষা বা এন্টিনেটাল চেকআপ নামে পরিচিত। চেকআপ যথাযথভাবে করলে গর্ভবতী মায়ের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব এবং গর্ভস্থ শিশুর সুস্থতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।’

গর্ভকালীন মায়েদের জন্য পূর্ব সতর্কতা

গর্ভকালীন মায়েদের জন্য আগেই সতর্কতা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তাও উল্লেখ করেন ডা. লেলিন। তিনি বলেন, বিয়ের আগে দম্পতিকে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত, যাতে জানা যায় তারা শারীরিকভাবে সুস্থ এবং গর্ভধারণের জন্য উপযুক্ত কি না। একইভাবে গর্ভধারণের আগে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, দম্পতির শরীরে এমন কোনো রোগ আছে কি না, যা গর্ভস্থ শিশুকে প্রভাবিত করতে পারে। এই ধরনের প্রাক-গর্ভধারণ পরীক্ষা সুস্থ শিশুর জন্ম দেওয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মুনিরা ফেরদৌসী বলেন, ‘অনেক সময় যেসব মায়ের আগে কখনো ডায়াবেটিস ছিল না, গর্ভকালীন অবস্থায় তাদেরও ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। কারণ, গর্ভকালীন সময়ে মায়ের শরীরে কিছু হরমোন তৈরি হয়, যা রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়ায়। এছাড়া, যেসব মায়ের বাবা-মা বা পূর্বপুরুষের কারও ডায়াবেটিস ছিল, তাদের গর্ভকালেও এই রোগ দেখা দিতে পারে। আবার কোনো মায়ের ডায়াবেটিস সুপ্ত অবস্থায় থাকলে সেটিও গর্ভাবস্থায় প্রকাশ পেতে পারে। যেসব মায়ের আগে থেকেই ডায়াবেটিস আছে, তাদের ক্ষেত্রে গর্ভকালীন সময়ে তা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই এমন মায়েদের আগে থেকেই সতর্ক থাকা জরুরি।’
ডা. মুনিরা ফেরদৌসী বলেন, ‘সন্তান নেওয়ার আগে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আনা অত্যন্ত জরুরি। কারণ, নিয়ন্ত্রণহীন ডায়াবেটিসে গর্ভকালীন জটিলতা দেখা দিতে পারে। এতে শিশু পেটেই মারা যাওয়া, প্রি-টার্ম ডেলিভারি, জন্মগত ত্রুটি (কনজেনিটাল অ্যানোমালি) বা গর্ভপাতের ঝুঁকি থাকে।’ 
তাই গর্ভধারণের আগে রক্তে শর্করার মাত্রা স্বাভাবিক রাখা, নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া এবং প্রয়োজন হলে ইনসুলিন ব্যবহারের পরামর্শ দেন এই চিকিৎসক।
এ ব্যাপারে ডা. মুনিরা ফেরদৌসী বলেন, ‘সাধারণত গর্ভাবস্থার ২০ সপ্তাহের পর গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। তখন নিয়মিত চেকআপ ও রক্তে শর্করার মাত্রা পর্যবেক্ষণ করতে হয়। ইনসুলিনই এ সময় সবচেয়ে নিরাপদ ওষুধ। কারণ এটি প্লাসেন্টা অতিক্রম করে শিশুর শরীরে যায় না, শুধু মায়ের শরীরে কাজ করে।’

ডায়াবেটিস যদি নিয়ন্ত্রণে না থাকে, তবে গর্ভের শিশুর নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমন- নার্ভাস সিস্টেমের ত্রুটি, নিউরাল টিউব ডিফেক্ট, চোখের সমস্যা (যেমন ক্যাটারাক্ট) এবং হৃদযন্ত্রের ত্রুটি। এজন্য গর্ভকালীন ডায়াবেটিস আক্রান্ত মায়েদের প্রতি ১৫ দিন পরপর ফলোআপে আসতে হয়। ইনসুলিন ব্যবহারকারী মায়েদের শেখানো হয় কীভাবে প্রতিদিন ঘরে বসে ব্লাড সুগার মাপতে হবে এবং খাবারের আগে-পরে নির্দিষ্ট মাত্রায় রাখতে হবে।

ডা. মুনিরা ফেরদৌসী বলেন, ‘মায়েদের নির্দিষ্ট খাবারের তালিকা অনুসরণ করতে হয় এবং খাবারের পর হালকা ব্যায়াম বা হাঁটাহাঁটি করা প্রয়োজন। অনেকেই মনে করেন মিষ্টি খেলেই ডায়াবেটিস হয়, এটি ভুল ধারণা। ডায়াবেটিস হওয়ার পরে সুগারযুক্ত খাবার বারণ করা হয়।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিরোধ মানে হচ্ছে, যাদের পরিবারের মধ্যে ডায়াবেটিসের ইতিহাস আছে, তারা গর্ভধারণের আগে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপন বজায় রাখার মাধ্যমে সব গর্ভবতী নারীই এ রোগের ঝুঁকি কমাতে পারেন।’

নিজস্ব প্রতিবেদক

১৪ নভেম্বর, ২০২৫,  6:01 PM

news image

বাংলাদেশে নারীদের গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্তের হার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। বর্তমানে এই হার ১০ শতাংশ বলে সাম্প্রতিক এক তথ্য বলছে। এরমধ্যে শহরাঞ্চলে বেশি, ১১ শতাংশ। গ্রামে আবার কম, ৯ শতাংশ। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গর্ভকালীন সময়ে একজন নারীর ওজন যত বাড়ে, ডায়াবেটিসে আক্রান্তের ঝুঁকিও তত প্রকট হয়। আক্রান্তদের প্রায় অর্ধেক ভবিষ্যতে টাইপ–২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারেন এবং পরবর্তীতে শিশুদেরও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। 

সে কারণে প্রত্যেক মাতৃসেবা কেন্দ্রে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করার পরামর্শ দিচ্ছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে গিয়ে রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত বেশিরভাগ নারীই শুরুতে এ রোগের লক্ষণ সম্পর্কে ধারণা রাখতেন না। চিকিৎসকের পরামর্শে পরীক্ষা করানোর পরেই তারা জানতে পারেন।

রাজধানীর তেজগাঁওয়ের গৃহিণী মাহমুদা আক্তার বলেন, ‘প্রথম দিকে শরীর একটু দুর্বল লাগত। কিন্তু ভাবিনি ডায়াবেটিস হতে পারে। পরে পরীক্ষা করানো পর ধরা পড়ে। এখন ওষুধ খাচ্ছি এবং ডায়েট মেনে চলার চেষ্টা করছি। নিয়মিত চেকআপ না করলে হয়তো জটিলতা বাড়ত।’

আজিমপুরের বাসিন্দা রুমানা খাতুন বলছেন, ‘গর্ভাবস্থার ছয় মাসে গিয়ে জানতে পারি আমার রক্তে শর্করা বেড়েছে। চিকিৎসক বললেন, এটা নিয়ন্ত্রণে না আনলে বাচ্চার ওজন বেড়ে যেতে পারে। এখন প্রতিদিন হাঁটাচলা করি, মিষ্টিজাত খাবার পুরোপুরি বন্ধ করেছি। নিয়ম মেনে চললে ভালো থাকা যায়—এটা এখন বুঝতে পারছি।’

চিকিৎসকরা বলছেন, সচেতনতা ও সময়মতো পরীক্ষা করালে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। এতে মা ও নবজাতক অনেকটাই ঝুঁকিমুক্ত থাকে। 

সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, শহরাঞ্চলের গর্ভবতী নারীদের মধ্যে ডায়াবেটিস রোগের প্রকোপ তুলনামূলক বেশি। দ্রুত নগরায়ণ, খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন ও কম শারীরিক পরিশ্রমের ফলে এই হার প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য গবেষকরা।
‘গর্ভাবস্থায় অ্যানিমিয়া, গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ও গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপের তুলনামূলক গবেষণা’ শীর্ষক একটি গবেষণা চালিয়েছেন গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজ ও গণবিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন গবেষক। তারা হলেন- ডা. শামীমা নাসরিন শাদিয়া, ডা. আয়েশা সিদ্দিকা এবং ডা. ফারজানা আফরোজ।

গবেষণায় দেখা গেছে, ২৬ শতাংশ গর্ভবতী নারী রক্তস্বল্পতায়, ১০ শতাংশ গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে এবং ৯ শতাংশ গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। শহরাঞ্চলে গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের হার ১১ শতাংশ, যা গ্রামীণ ও আধা-শহরাঞ্চলের তুলনায় স্পষ্টতই বেশি। আক্রান্তদের ৭৬ শতাংশ নারী গৃহিণী, ১৭ শতাংশ পোশাককর্মী এবং বাকিরা অন্যান্য পেশায় যুক্ত। 

শহরাঞ্চলে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের হার বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে পরিবর্তিত জীবনযাপন, স্থবিরতা, অতিরিক্ত মানসিক চাপ এবং প্রসবকালীন বয়সের বিলম্ব। বিশেষ করে কর্মজীবী ও মধ্যবিত্ত নারীদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি। গর্ভবতী নারীদের ওজন ও রক্তে শর্করার মাত্রার মধ্যে ইতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে। অর্থাৎ শরীরের ওজন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রক্তে শর্করার মাত্রাও বেড়ে যায়।

বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাবেক গবেষক সুব্রিনা জেসমিনের ২০১৪ সালের গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের হার ছিল ৯ দশমিক ৭ শতাংশ (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী) এবং ১২ দশমিক ৯ শতাংশ (আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশনের মানদণ্ড অনুযায়ী)। সেই হিসেবে বর্তমান গবেষণায় পাওয়া ১১ শতাংশ হার নির্দেশ করছে যে, বাংলাদেশে এই রোগের বিস্তার অব্যাহতভাবে বাড়ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, গর্ভকালীন ডায়াবেটিস শুধু মায়ের নয়, নবজাতকেরও স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। এতে শিশুর স্থূলতা, জন্ম-পরবর্তী ডায়াবেটিস ও শারীরিক জটিলতার ঝুঁকি বাড়ায়। তাছাড়া মায়েরও দীর্ঘমেয়াদে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। 

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের হার নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে প্রতিটি গর্ভবতী নারীকে গর্ভধারণের প্রথম পর্যায় থেকেই নিয়মিত রক্তে শর্করা পরীক্ষা করানো জরুরি বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞারা। একইসঙ্গে সুষম খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম এবং মানসিক চাপ কমানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

এছাড়া প্রত্যেক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস পরীক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা, গর্ভবতী নারীদের জন্য সুষম খাদ্য ও আয়রন সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং প্রজনন স্বাস্থ্যসেবায় সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা জরুরি। কারণ, আগাম শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা ছাড়া এই সমস্যা ভবিষ্যতে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার বাড়াতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘গর্ভবতী মায়ের যদি ডায়াবেটিস থাকে এবং তা নিয়ন্ত্রণে না থাকে, তাহলে গর্ভস্থ শিশুর ওজন অত্যধিক বৃদ্ধি পেতে পারে, অঙ্গ-প্রতঙ্গের গঠনে সমস্যা হতে পারে, অপূর্ণাঙ্গ জন্মের সম্ভাবনা থাকে, কখনো কখনো শারীরিক ত্রুটি দেখা দিতে পারে এবং গুরুতর ক্ষেত্রে শিশুর মৃত্যুও ঘটতে পারে। তাই গর্ভবতী মায়ের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত জরুরি।

এই চিকিৎসক আরও বলেন, ‘গর্ভকালীন এই ধরনের ডায়াবেটিসকে আমরা ‘জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস’ বা গর্ভবতী মায়ের ডায়াবেটিস বলি। এটি সাধারণ সময় দেখা যায় না, তবে গর্ভধারণের সময় ধীরে ধীরে বিকাশ হয়। এই কারণে গর্ভধারণের পর থেকে সন্তান প্রসব হওয়া পর্যন্ত মায়ের নিয়মিত পরীক্ষা অত্যাবশ্যক।’

ডা. লেলিন বলেন, ‘একজন চিকিৎসক বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থেকে নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর মা এবং গর্ভস্থ শিশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। এটিই গর্ভকালীন পরীক্ষা বা এন্টিনেটাল চেকআপ নামে পরিচিত। চেকআপ যথাযথভাবে করলে গর্ভবতী মায়ের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব এবং গর্ভস্থ শিশুর সুস্থতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।’

গর্ভকালীন মায়েদের জন্য পূর্ব সতর্কতা

গর্ভকালীন মায়েদের জন্য আগেই সতর্কতা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তাও উল্লেখ করেন ডা. লেলিন। তিনি বলেন, বিয়ের আগে দম্পতিকে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত, যাতে জানা যায় তারা শারীরিকভাবে সুস্থ এবং গর্ভধারণের জন্য উপযুক্ত কি না। একইভাবে গর্ভধারণের আগে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, দম্পতির শরীরে এমন কোনো রোগ আছে কি না, যা গর্ভস্থ শিশুকে প্রভাবিত করতে পারে। এই ধরনের প্রাক-গর্ভধারণ পরীক্ষা সুস্থ শিশুর জন্ম দেওয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মুনিরা ফেরদৌসী বলেন, ‘অনেক সময় যেসব মায়ের আগে কখনো ডায়াবেটিস ছিল না, গর্ভকালীন অবস্থায় তাদেরও ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। কারণ, গর্ভকালীন সময়ে মায়ের শরীরে কিছু হরমোন তৈরি হয়, যা রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়ায়। এছাড়া, যেসব মায়ের বাবা-মা বা পূর্বপুরুষের কারও ডায়াবেটিস ছিল, তাদের গর্ভকালেও এই রোগ দেখা দিতে পারে। আবার কোনো মায়ের ডায়াবেটিস সুপ্ত অবস্থায় থাকলে সেটিও গর্ভাবস্থায় প্রকাশ পেতে পারে। যেসব মায়ের আগে থেকেই ডায়াবেটিস আছে, তাদের ক্ষেত্রে গর্ভকালীন সময়ে তা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই এমন মায়েদের আগে থেকেই সতর্ক থাকা জরুরি।’
ডা. মুনিরা ফেরদৌসী বলেন, ‘সন্তান নেওয়ার আগে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আনা অত্যন্ত জরুরি। কারণ, নিয়ন্ত্রণহীন ডায়াবেটিসে গর্ভকালীন জটিলতা দেখা দিতে পারে। এতে শিশু পেটেই মারা যাওয়া, প্রি-টার্ম ডেলিভারি, জন্মগত ত্রুটি (কনজেনিটাল অ্যানোমালি) বা গর্ভপাতের ঝুঁকি থাকে।’ 
তাই গর্ভধারণের আগে রক্তে শর্করার মাত্রা স্বাভাবিক রাখা, নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া এবং প্রয়োজন হলে ইনসুলিন ব্যবহারের পরামর্শ দেন এই চিকিৎসক।
এ ব্যাপারে ডা. মুনিরা ফেরদৌসী বলেন, ‘সাধারণত গর্ভাবস্থার ২০ সপ্তাহের পর গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। তখন নিয়মিত চেকআপ ও রক্তে শর্করার মাত্রা পর্যবেক্ষণ করতে হয়। ইনসুলিনই এ সময় সবচেয়ে নিরাপদ ওষুধ। কারণ এটি প্লাসেন্টা অতিক্রম করে শিশুর শরীরে যায় না, শুধু মায়ের শরীরে কাজ করে।’

ডায়াবেটিস যদি নিয়ন্ত্রণে না থাকে, তবে গর্ভের শিশুর নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমন- নার্ভাস সিস্টেমের ত্রুটি, নিউরাল টিউব ডিফেক্ট, চোখের সমস্যা (যেমন ক্যাটারাক্ট) এবং হৃদযন্ত্রের ত্রুটি। এজন্য গর্ভকালীন ডায়াবেটিস আক্রান্ত মায়েদের প্রতি ১৫ দিন পরপর ফলোআপে আসতে হয়। ইনসুলিন ব্যবহারকারী মায়েদের শেখানো হয় কীভাবে প্রতিদিন ঘরে বসে ব্লাড সুগার মাপতে হবে এবং খাবারের আগে-পরে নির্দিষ্ট মাত্রায় রাখতে হবে।

ডা. মুনিরা ফেরদৌসী বলেন, ‘মায়েদের নির্দিষ্ট খাবারের তালিকা অনুসরণ করতে হয় এবং খাবারের পর হালকা ব্যায়াম বা হাঁটাহাঁটি করা প্রয়োজন। অনেকেই মনে করেন মিষ্টি খেলেই ডায়াবেটিস হয়, এটি ভুল ধারণা। ডায়াবেটিস হওয়ার পরে সুগারযুক্ত খাবার বারণ করা হয়।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিরোধ মানে হচ্ছে, যাদের পরিবারের মধ্যে ডায়াবেটিসের ইতিহাস আছে, তারা গর্ভধারণের আগে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপন বজায় রাখার মাধ্যমে সব গর্ভবতী নারীই এ রোগের ঝুঁকি কমাতে পারেন।’