ড. রাধেশ্যাম সরকার
১১ নভেম্বর, ২০২৫, 5:02 PM
সৃষ্টির আদিকাল থেকেই নারী ও পুরুষ মানবসমাজের বিকাশে একত্রে কাজ করে আসছে। সেই প্রাচীন কাল থেকে সমাজে দায়িত্ব বণ্টনের একটি স্বাভাবিক কাঠামো গড়ে ওঠে, যেখানে নারীদের কাজ ছিল ঘর সামলানো আর পুরুষদের কাজ ছিল বাইরের জগতের সঙ্গে যুক্ত থাকা। স্ত্রী, মাতা, পরিবার রক্ষক ও পরিচর্যাকারীর ভূমিকায় নারীরা দীর্ঘদিন নিজেদের অবস্থান বজায় রেখেছেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সভ্যতার অগ্রগতি, শিক্ষার প্রসার এবং সমাজ-সংস্কৃতির পরিবর্তনের ফলে নারীর কাজের পরিধি ও পরিচয়ের পরিসর ক্রমেই বিস্তৃত হয়েছে। আজ নারীরা শুধু রান্নাঘর বা গৃহস্থালি কাজে সীমাবদ্ধ নন, বরং ঘর-সংসারের দায়িত্বের পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে নিজেদের যোগ্যতা, নৈপুণ্য এবং মেধার প্রমাণ দিচ্ছেন।
আজ একজন নারী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন, শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ও মননশীলতা বিকাশের জন্য সময় দিচ্ছেন এবং তদূপরি গবেষণা ও পাঠ্যক্রমের উন্নয়নে অবদান রাখছেন। একই সময়ে হাসপাতাল ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নারীরা রোগীদের যত্নে নিয়োজিত রয়েছেন, জীবন রক্ষা ও সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্য প্রতিনিয়ত কঠোর পরিশ্রম করছেন। আদালতে বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী নারীরা ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও সামাজিক সুবিচারের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন, যেখানে তাদের সিদ্ধান্ত সমাজে ন্যায়বিচারের সূক্ষ্ম ভারসাম্য স্থাপন করে। অন্যদিকে, প্রকৌশল ল্যাবে গবেষণা ও উদ্ভাবনমূলক প্রকল্পে নিযুক্ত নারীরা বৈজ্ঞানিক জ্ঞান এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতার মাধ্যমে দেশের অগ্রগতিতে অবদান রাখছেন। তাছাড়া, বিমান চালক হিসেবে আকাশপথে দায়িত্ব পালন, উচ্চ সরকারি পদে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা কিংবা শিল্পকলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দেওয়া প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর অবদান সুস্পষ্ট এবং দৃশ্যমান। সমাজ, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, শিল্পকলা, সংস্কৃতি, প্রশাসন এবং রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর এই সক্রিয় ও বহুমাত্রিক ভূমিকা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, নারী শুধুমাত্র পরিবার সীমাবদ্ধ নয়; বরং রাষ্ট্র ও সমাজের সার্বিক অগ্রগতিতে তিনি সমান ও অপরিহার্য অবদান রাখছেন।
কিন্তু এই কর্মময় ও দায়িত্বপূর্ণ জীবনের এক পর্যায়ে এসে প্রতিটি নারী ও পুরুষকেই অবসর গ্রহণ করতে হয়। অবসর গ্রহণ জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ, সংবেদনশীল এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে ধরা হয়, যা ব্যক্তির মানসিক ও সামাজিক জীবনে নতুন পরিবর্তনের সূচনা করে। অনেকেই মনে করেন যে অবসর মানে শুধুমাত্র বিশ্রাম, আরাম এবং শান্তির সময়, তবে বাস্তবতা সবসময় এটি এমন সরল ও একরূপ নয়। দিনের সকালের ব্যস্ততা, কর্মক্ষেত্রের দায়িত্ব পালন, সহকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন এবং প্রতিদিনের লক্ষ্যপূরণের অভ্যাস এই সবের যে ধারাবাহিকতা বছর বছর গড়ে ওঠে, অবসরের পর তা হঠাৎ থেমে গেলে অনেকেই গভীর মানসিক শূন্যতা, উদাসীনতা এবং শিথিলতার অনুভূতি অনুভব করেন। বিশেষ করে পুরুষদের ক্ষেত্রে কর্মজীবন প্রায়শই তাদের পরিচয়ের প্রধান উৎস হয়ে ওঠে এবং সমাজে মর্যাদা, আত্মসম্মান এবং গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ভূমিকার সঙ্গে তাদের সংযুক্তি গড়ে তোলে। ফলে অবসরের সঙ্গে সঙ্গে অনেক পুরুষই নিজেদেরকে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা বা অর্থহীনতার মধ্যে খুঁজে পান। এই সময় অনেকেই উদ্বেগ, হতাশা, একাকীত্ব এবং অনিশ্চয়তার বৃত্তে পড়েন, যেখানে তারা নতুন জীবনের অভ্যস্ত রুটিন ও অর্থপূর্ণ কার্যকলাপের অভাব অনুভব করেন।
কিন্তু পুরুষের তুলনায় নারীদের ক্ষেত্রে অবসর গ্রহণের পর পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন এবং তুলনামূলকভাবে কম জটিল হয়। একজন চাকরিজীবী নারী সারাজীবন ধরে দ্বৈত দায়িত্ব পালন করে আসেন যেমন অফিসের কাজ শেষ করার পরও ঘরে ফিরেই তার উপর অপেক্ষমাণ বিভিন্ন দায়িত্বের বোঝা থাকে। ঘরের কাজ যেমন রান্না, বাজার করা, সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব পালন, সন্তানের পড়াশোনা তদারকি, অসুস্থ পরিবারের সদস্যদের যত্ন নেওয়া, সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্ক বজায় রাখা এই সব ক্ষেত্রেই তাকে সর্বদা সজাগ, সক্রিয় এবং মনোযোগী ভূমিকা রাখতে হয়। এই দীর্ঘদিনের অভ্যাসের কারণে কর্মজীবনের শেষ পর্যায়ে অবসরে যাওয়ার পরও নারীর মানসিক অবস্থা উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয় না। কারণ তিনি আগে থেকেই নিজের জীবনকে ঘর এবং কর্মক্ষেত্র উভয় ক্ষেত্রেই সমানভাবে সক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করার অভ্যাসে অভ্যস্ত ছিলেন। ফলে, অবসরের সঙ্গে যুক্ত নতুন জীবনের পরিবর্তন নারীর জন্য তুলনামূলকভাবে স্বাভাবিক এবং গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে, যেখানে মানসিক চাপ বা হতাশার অনুভূতি পুরুষের মতো তীব্রভাবে প্রকাশ পায় না।
তবুও একটি তিক্ত বাস্তবতা হলো, নারী যখন অবসর গ্রহণ করেন, পরিবারের অধিকাংশ সদস্য তাঁকে স্বাভাবিকভাবে গৃহকর্মের প্রধান দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে ধরে নেন। অন্যদিকে, যখন একজন পুরুষ অবসর নেন, তখন তাঁকে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য উৎসাহ দেওয়া হয় এবং তার জন্য নতুন কিছু করার, শখ বা মানসিক আনন্দের ক্রিয়াকলাপে নিজেকে ব্যস্ত রাখার অনুপ্রেরণা প্রদান করা হয়। কিন্তু নারীর ক্ষেত্রে অবস্থা কিছুটা ভিন্ন। নারী অবসর নিলে সাধারণ ধারণা তৈরি হয় যে, তিনি এখন সারাদিন বাড়িতেই থাকবেন এবং সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব রান্না, পরিচ্ছন্নতা, বাজার করা, সন্তান বা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের যত্ন তিনি স্বাচ্ছন্দ্যে, সুন্দরভাবে এবং নিরবিচ্ছিন্নভাবে সামলাবেন। ফলে, অবসর গ্রহণের পর নারীর দৈনন্দিন দায়িত্বের পরিমাণ কমে না; বরং অনেক ক্ষেত্রে এটি আরও বৃদ্ধি পায়, কারণ পরিবারের প্রত্যাশা অনুযায়ী তিনি কর্মজীবনের মতোই বা তার থেকেও বেশি শ্রম ও মনোযোগ দিয়ে ঘরের কাজগুলো সম্পন্ন করেন। এভাবে নারীর অবসর জীবনে শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম প্রায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে বৃদ্ধি পায়, যেখানে পুরুষের ক্ষেত্রে অনেকটাই আরাম ও বিশ্রামের সুযোগ তৈরি হয়।
চাকরি জীবনে একজন নারী প্রতিদিন সকালে ঘর গোছানো, রান্না প্রস্তুত, সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠানো, স্বামী ও শ্বশুর-শাশুড়ির প্রয়োজন মেটানো এসব করে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হতেন। পথ চলার বিড়ম্বনা থেকে শুরু করে কর্মস্থলের চাপ, দায়িত্ব পালনের প্রতিযোগিতা, সহকর্মীদের মনোভাব সব সামলাতে হতো তাঁকে। অনেক সময় তাঁর দক্ষতা ও শ্রমের সঠিক মূল্যায়নও হতো না। অবসর গ্রহণের পর তিনি এই বাহ্যিক চাপ থেকে মুক্তি পেলেও সংসারের দায়িত্ব থেকে মোটেই মুক্ত হন না। পরিবারের সদস্যরা অনেকসময় মনে করেন, মা বা স্ত্রী এখন বাসায় থাকছেন, তাই তিনি নিশ্চিন্তে ঘরের সব কাজ করে দেবেন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত রান্না, অতিথি আপ্যায়ন, ঘর পরিষ্কার, ওষুধ-পথ্য দেখাশুনা সব দায়িত্ব তাঁর। কাজের বিনিময়ে অর্থ উপার্জন বন্ধ হয়ে গেলেও তাঁর শ্রমের প্রয়োজন ও গুরুত্ব থাকে আগের মতোই, বরং কোনো কোনো পরিবারে তা আরও বেড়ে যায়।
তবে অন্য এক বাস্তবতাও আছে। অনেক ক্ষেত্রে অবসরপ্রাপ্ত মায়ের প্রতি পরিবারের ভালোবাসা, নির্ভরতা এবং শ্রদ্ধা আরও বৃদ্ধি পায়। সন্তানরা যখন নিজেরা বাবা-মা হন, তখন তারা উপলব্ধি করেন সন্তান লালন-পালন ও সংসার চালানো কত কঠিন একটি কাজ। ফলে নাতি-নাতনিদের দেখাশোনা, স্কুলে আনা-নেওয়া, অসুস্থতার সময়ে যত্ন নেওয়া এসব কাজে সন্তানেরা মায়ের সাহায্য চান। বিশেষ করে বিদেশে থাকা সন্তানেরা অবসরপ্রাপ্ত বাবার তুলনায় মাকেই বেশি নিজেদের কাছে নিয়ে যেতে চান, কারণ মা এই কাজগুলো বেশি আন্তরিকতা ও স্নেহ দিয়ে পালন করেন।
নানী বা দাদী হয়ে ওঠেন পরিবারের ইতিহাস, স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার বর্ণনাকারী। নাতি-নাতনিদের কাছে তাঁর গল্প কেবল গল্প নয় তা হয়ে ওঠে জীবনের শিক্ষা, আদর্শ ও ভালোবাসার উৎস। এতে তাঁর মানসিক সুস্থতা বজায় থাকে এবং তিনি অনুভব করেন যে তিনি এখনো প্রয়োজনীয়, এখনও ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দু। ফলে দেখা যায়, অবসরপ্রাপ্ত নারীরা অনেক ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় মানসিকভাবে স্থিতিশীল থাকেন। কারণ তাদের জীবনে কর্মস্থল ছাড়াও রয়েছে পরিবার, সন্তান, নাতি-নাতনির মাধ্যমে স্নেহের সম্পর্ক এবং সক্রিয়তার আরেকটি বিস্তৃত ক্ষেত্র।
সব মিলিয়ে বলা যায়, অবসর জীবনে নারীদের চ্যালেঞ্জ কম নয়, তবে তাদের সামাজিক সংযুক্তি, আবেগিক বন্ধন, দৈনন্দিন সক্রিয়তা এবং দায়িত্বের ধারাবাহিকতার কারণে তারা তুলনামূলকভাবে দ্রুত নতুন জীবনধারণে মানিয়ে নিতে পারেন। তাই অবসরপ্রাপ্ত নারীর জীবনকে শুধু ঘরের কাজের জন্য নয়, বরং পরিবার এবং সমাজজীবনে তাঁর অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, স্নেহ এবং মূল্যবোধের ধারক হিসেবে সম্মান দেওয়া প্রয়োজন। তাদের অবসর যেন সম্মান, শান্তি এবং পরিপূর্ণতার নতুন অধ্যায় হয়ে ওঠে, এটাই হওয়া উচিত সমাজের লক্ষ্য।
লেখক: কৃষিবিদ, কলাম লেখক ও চেয়ারম্যান, ডিআরপি ফাউন্ডেশন।
ড. রাধেশ্যাম সরকার
১১ নভেম্বর, ২০২৫, 5:02 PM
সৃষ্টির আদিকাল থেকেই নারী ও পুরুষ মানবসমাজের বিকাশে একত্রে কাজ করে আসছে। সেই প্রাচীন কাল থেকে সমাজে দায়িত্ব বণ্টনের একটি স্বাভাবিক কাঠামো গড়ে ওঠে, যেখানে নারীদের কাজ ছিল ঘর সামলানো আর পুরুষদের কাজ ছিল বাইরের জগতের সঙ্গে যুক্ত থাকা। স্ত্রী, মাতা, পরিবার রক্ষক ও পরিচর্যাকারীর ভূমিকায় নারীরা দীর্ঘদিন নিজেদের অবস্থান বজায় রেখেছেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সভ্যতার অগ্রগতি, শিক্ষার প্রসার এবং সমাজ-সংস্কৃতির পরিবর্তনের ফলে নারীর কাজের পরিধি ও পরিচয়ের পরিসর ক্রমেই বিস্তৃত হয়েছে। আজ নারীরা শুধু রান্নাঘর বা গৃহস্থালি কাজে সীমাবদ্ধ নন, বরং ঘর-সংসারের দায়িত্বের পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে নিজেদের যোগ্যতা, নৈপুণ্য এবং মেধার প্রমাণ দিচ্ছেন।
আজ একজন নারী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন, শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ও মননশীলতা বিকাশের জন্য সময় দিচ্ছেন এবং তদূপরি গবেষণা ও পাঠ্যক্রমের উন্নয়নে অবদান রাখছেন। একই সময়ে হাসপাতাল ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নারীরা রোগীদের যত্নে নিয়োজিত রয়েছেন, জীবন রক্ষা ও সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্য প্রতিনিয়ত কঠোর পরিশ্রম করছেন। আদালতে বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী নারীরা ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও সামাজিক সুবিচারের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন, যেখানে তাদের সিদ্ধান্ত সমাজে ন্যায়বিচারের সূক্ষ্ম ভারসাম্য স্থাপন করে। অন্যদিকে, প্রকৌশল ল্যাবে গবেষণা ও উদ্ভাবনমূলক প্রকল্পে নিযুক্ত নারীরা বৈজ্ঞানিক জ্ঞান এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতার মাধ্যমে দেশের অগ্রগতিতে অবদান রাখছেন। তাছাড়া, বিমান চালক হিসেবে আকাশপথে দায়িত্ব পালন, উচ্চ সরকারি পদে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা কিংবা শিল্পকলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দেওয়া প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর অবদান সুস্পষ্ট এবং দৃশ্যমান। সমাজ, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, শিল্পকলা, সংস্কৃতি, প্রশাসন এবং রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর এই সক্রিয় ও বহুমাত্রিক ভূমিকা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, নারী শুধুমাত্র পরিবার সীমাবদ্ধ নয়; বরং রাষ্ট্র ও সমাজের সার্বিক অগ্রগতিতে তিনি সমান ও অপরিহার্য অবদান রাখছেন।
কিন্তু এই কর্মময় ও দায়িত্বপূর্ণ জীবনের এক পর্যায়ে এসে প্রতিটি নারী ও পুরুষকেই অবসর গ্রহণ করতে হয়। অবসর গ্রহণ জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ, সংবেদনশীল এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে ধরা হয়, যা ব্যক্তির মানসিক ও সামাজিক জীবনে নতুন পরিবর্তনের সূচনা করে। অনেকেই মনে করেন যে অবসর মানে শুধুমাত্র বিশ্রাম, আরাম এবং শান্তির সময়, তবে বাস্তবতা সবসময় এটি এমন সরল ও একরূপ নয়। দিনের সকালের ব্যস্ততা, কর্মক্ষেত্রের দায়িত্ব পালন, সহকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন এবং প্রতিদিনের লক্ষ্যপূরণের অভ্যাস এই সবের যে ধারাবাহিকতা বছর বছর গড়ে ওঠে, অবসরের পর তা হঠাৎ থেমে গেলে অনেকেই গভীর মানসিক শূন্যতা, উদাসীনতা এবং শিথিলতার অনুভূতি অনুভব করেন। বিশেষ করে পুরুষদের ক্ষেত্রে কর্মজীবন প্রায়শই তাদের পরিচয়ের প্রধান উৎস হয়ে ওঠে এবং সমাজে মর্যাদা, আত্মসম্মান এবং গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ভূমিকার সঙ্গে তাদের সংযুক্তি গড়ে তোলে। ফলে অবসরের সঙ্গে সঙ্গে অনেক পুরুষই নিজেদেরকে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা বা অর্থহীনতার মধ্যে খুঁজে পান। এই সময় অনেকেই উদ্বেগ, হতাশা, একাকীত্ব এবং অনিশ্চয়তার বৃত্তে পড়েন, যেখানে তারা নতুন জীবনের অভ্যস্ত রুটিন ও অর্থপূর্ণ কার্যকলাপের অভাব অনুভব করেন।
কিন্তু পুরুষের তুলনায় নারীদের ক্ষেত্রে অবসর গ্রহণের পর পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন এবং তুলনামূলকভাবে কম জটিল হয়। একজন চাকরিজীবী নারী সারাজীবন ধরে দ্বৈত দায়িত্ব পালন করে আসেন যেমন অফিসের কাজ শেষ করার পরও ঘরে ফিরেই তার উপর অপেক্ষমাণ বিভিন্ন দায়িত্বের বোঝা থাকে। ঘরের কাজ যেমন রান্না, বাজার করা, সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব পালন, সন্তানের পড়াশোনা তদারকি, অসুস্থ পরিবারের সদস্যদের যত্ন নেওয়া, সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্ক বজায় রাখা এই সব ক্ষেত্রেই তাকে সর্বদা সজাগ, সক্রিয় এবং মনোযোগী ভূমিকা রাখতে হয়। এই দীর্ঘদিনের অভ্যাসের কারণে কর্মজীবনের শেষ পর্যায়ে অবসরে যাওয়ার পরও নারীর মানসিক অবস্থা উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয় না। কারণ তিনি আগে থেকেই নিজের জীবনকে ঘর এবং কর্মক্ষেত্র উভয় ক্ষেত্রেই সমানভাবে সক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করার অভ্যাসে অভ্যস্ত ছিলেন। ফলে, অবসরের সঙ্গে যুক্ত নতুন জীবনের পরিবর্তন নারীর জন্য তুলনামূলকভাবে স্বাভাবিক এবং গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে, যেখানে মানসিক চাপ বা হতাশার অনুভূতি পুরুষের মতো তীব্রভাবে প্রকাশ পায় না।
তবুও একটি তিক্ত বাস্তবতা হলো, নারী যখন অবসর গ্রহণ করেন, পরিবারের অধিকাংশ সদস্য তাঁকে স্বাভাবিকভাবে গৃহকর্মের প্রধান দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে ধরে নেন। অন্যদিকে, যখন একজন পুরুষ অবসর নেন, তখন তাঁকে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য উৎসাহ দেওয়া হয় এবং তার জন্য নতুন কিছু করার, শখ বা মানসিক আনন্দের ক্রিয়াকলাপে নিজেকে ব্যস্ত রাখার অনুপ্রেরণা প্রদান করা হয়। কিন্তু নারীর ক্ষেত্রে অবস্থা কিছুটা ভিন্ন। নারী অবসর নিলে সাধারণ ধারণা তৈরি হয় যে, তিনি এখন সারাদিন বাড়িতেই থাকবেন এবং সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব রান্না, পরিচ্ছন্নতা, বাজার করা, সন্তান বা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের যত্ন তিনি স্বাচ্ছন্দ্যে, সুন্দরভাবে এবং নিরবিচ্ছিন্নভাবে সামলাবেন। ফলে, অবসর গ্রহণের পর নারীর দৈনন্দিন দায়িত্বের পরিমাণ কমে না; বরং অনেক ক্ষেত্রে এটি আরও বৃদ্ধি পায়, কারণ পরিবারের প্রত্যাশা অনুযায়ী তিনি কর্মজীবনের মতোই বা তার থেকেও বেশি শ্রম ও মনোযোগ দিয়ে ঘরের কাজগুলো সম্পন্ন করেন। এভাবে নারীর অবসর জীবনে শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম প্রায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে বৃদ্ধি পায়, যেখানে পুরুষের ক্ষেত্রে অনেকটাই আরাম ও বিশ্রামের সুযোগ তৈরি হয়।
চাকরি জীবনে একজন নারী প্রতিদিন সকালে ঘর গোছানো, রান্না প্রস্তুত, সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠানো, স্বামী ও শ্বশুর-শাশুড়ির প্রয়োজন মেটানো এসব করে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হতেন। পথ চলার বিড়ম্বনা থেকে শুরু করে কর্মস্থলের চাপ, দায়িত্ব পালনের প্রতিযোগিতা, সহকর্মীদের মনোভাব সব সামলাতে হতো তাঁকে। অনেক সময় তাঁর দক্ষতা ও শ্রমের সঠিক মূল্যায়নও হতো না। অবসর গ্রহণের পর তিনি এই বাহ্যিক চাপ থেকে মুক্তি পেলেও সংসারের দায়িত্ব থেকে মোটেই মুক্ত হন না। পরিবারের সদস্যরা অনেকসময় মনে করেন, মা বা স্ত্রী এখন বাসায় থাকছেন, তাই তিনি নিশ্চিন্তে ঘরের সব কাজ করে দেবেন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত রান্না, অতিথি আপ্যায়ন, ঘর পরিষ্কার, ওষুধ-পথ্য দেখাশুনা সব দায়িত্ব তাঁর। কাজের বিনিময়ে অর্থ উপার্জন বন্ধ হয়ে গেলেও তাঁর শ্রমের প্রয়োজন ও গুরুত্ব থাকে আগের মতোই, বরং কোনো কোনো পরিবারে তা আরও বেড়ে যায়।
তবে অন্য এক বাস্তবতাও আছে। অনেক ক্ষেত্রে অবসরপ্রাপ্ত মায়ের প্রতি পরিবারের ভালোবাসা, নির্ভরতা এবং শ্রদ্ধা আরও বৃদ্ধি পায়। সন্তানরা যখন নিজেরা বাবা-মা হন, তখন তারা উপলব্ধি করেন সন্তান লালন-পালন ও সংসার চালানো কত কঠিন একটি কাজ। ফলে নাতি-নাতনিদের দেখাশোনা, স্কুলে আনা-নেওয়া, অসুস্থতার সময়ে যত্ন নেওয়া এসব কাজে সন্তানেরা মায়ের সাহায্য চান। বিশেষ করে বিদেশে থাকা সন্তানেরা অবসরপ্রাপ্ত বাবার তুলনায় মাকেই বেশি নিজেদের কাছে নিয়ে যেতে চান, কারণ মা এই কাজগুলো বেশি আন্তরিকতা ও স্নেহ দিয়ে পালন করেন।
নানী বা দাদী হয়ে ওঠেন পরিবারের ইতিহাস, স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার বর্ণনাকারী। নাতি-নাতনিদের কাছে তাঁর গল্প কেবল গল্প নয় তা হয়ে ওঠে জীবনের শিক্ষা, আদর্শ ও ভালোবাসার উৎস। এতে তাঁর মানসিক সুস্থতা বজায় থাকে এবং তিনি অনুভব করেন যে তিনি এখনো প্রয়োজনীয়, এখনও ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দু। ফলে দেখা যায়, অবসরপ্রাপ্ত নারীরা অনেক ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় মানসিকভাবে স্থিতিশীল থাকেন। কারণ তাদের জীবনে কর্মস্থল ছাড়াও রয়েছে পরিবার, সন্তান, নাতি-নাতনির মাধ্যমে স্নেহের সম্পর্ক এবং সক্রিয়তার আরেকটি বিস্তৃত ক্ষেত্র।
সব মিলিয়ে বলা যায়, অবসর জীবনে নারীদের চ্যালেঞ্জ কম নয়, তবে তাদের সামাজিক সংযুক্তি, আবেগিক বন্ধন, দৈনন্দিন সক্রিয়তা এবং দায়িত্বের ধারাবাহিকতার কারণে তারা তুলনামূলকভাবে দ্রুত নতুন জীবনধারণে মানিয়ে নিতে পারেন। তাই অবসরপ্রাপ্ত নারীর জীবনকে শুধু ঘরের কাজের জন্য নয়, বরং পরিবার এবং সমাজজীবনে তাঁর অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, স্নেহ এবং মূল্যবোধের ধারক হিসেবে সম্মান দেওয়া প্রয়োজন। তাদের অবসর যেন সম্মান, শান্তি এবং পরিপূর্ণতার নতুন অধ্যায় হয়ে ওঠে, এটাই হওয়া উচিত সমাজের লক্ষ্য।
লেখক: কৃষিবিদ, কলাম লেখক ও চেয়ারম্যান, ডিআরপি ফাউন্ডেশন।