CKEditor 5 Sample
ঢাকা ২০ নভেম্বর, ২০২৫

পরিবেশ রক্ষায় গাছ কেন প্রয়োজন

#
news image

গাছ পরিবেশের অকৃত্রিম বন্ধু। মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে গাছ কোনো না কোনো উপায়ে মানবকল্যাণে কাজ করে যায়। পৃথিবীর সামগ্রিক পরিবেশব্যবস্থায় জীববৈচিত্র্য রক্ষা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধ, পানি ও বায়ুর মান নিয়ন্ত্রণ, জলবায়ুকে সহনীয় রাখা এবং খাদ্য ও আশ্রয় সরবরাহে গাছ এক অনন্য অনুষঙ্গ। গাছ প্রকৃতির সেই মৌন ভৃত্য, যে প্রতিদানে কিছুই চায় না, অথচ নিরলসভাবে জীবনকে টিকিয়ে রাখে। বৃক্ষরাজি ও প্রাণীকুল একে অপরের পরিপূরক। এই সম্পর্ক ভেঙে গেলে পৃথিবীর পরিবেশব্যবস্থা ভেঙে পড়বে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে মানবসভ্যতা।

গাছের মূল ভূমিকা হলো বায়ুমণ্ডলের কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে অক্সিজেন উৎপাদন করা। পৃথিবীর প্রাণীকুলের টিকে থাকার জন্য এই অক্সিজেন অনন্য ও অপরিহার্য। বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে, একটি পূর্ণবয়স্ক গাছ প্রতিদিন প্রায় ২২ কেজি কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে এবং প্রায় ১৮ থেকে ২০ জন মানুষের দৈনন্দিন অক্সিজেন সরবরাহ করতে সক্ষম হয়। আবার অনেক গবেষণা অনুযায়ী একটি মাঝারি আকারের সবজি গাছ প্রায় তিন মাসে তিনজন মানুষের অক্সিজেনের চাহিদা পূরণ করতে পারে। অর্থাৎ গাছ একদিকে বায়ুকে বিশুদ্ধ রাখে, অন্যদিকে অতিরিক্ত গ্রীনহাউস গ্যাস কমিয়ে বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। বিশ্বের মোট কার্বন নিঃসরণের অন্তত ২৫ শতাংশ শোষণ করে বিশ্বের বনাঞ্চল। সুতরাং গাছ প্রকৃতির বায়ুফিল্টার, যা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অপরিসীম ভূমিকা পালন করে।

গাছ অতিরিক্ত তাপমাত্রা শোষণ করে পরিবেশকে শীতল রাখে। শহর এলাকায় যেখানে কংক্রিটের দেয়াল, লোহা ও কাচের আধিক্য, সেখানে তাপমাত্রা গ্রাম অঞ্চলের তুলনায় ৩ থেকে ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেশি হয়ে থাকে। একে "আরবান হিট আইল্যান্ড ইফেক্ট" বলা হয়। শহরে যদি পর্যাপ্ত গাছ লাগানো যায়, ছায়ানিবিড় রাস্তা তৈরি হয়, তবে তাপমাত্রা স্বাভাবিক হয়ে মানুষের বসবাস আরামদায়ক হয়। বিশ্বব্যাপী অনেক শহরে সড়কের দুই পাশে গাছ রোপণ করে তাপমাত্রা গড়ে ৫ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে।

গাছ শুধু বায়ু নয়, পানি প্রবাহও নিয়ন্ত্রণ করে। গাছের শিকড় মাটি শক্ত করে ধ্বস, ভাঙ্গন এবং বৃষ্টির পানি ধারণে সহায়তা করে। যদি পর্যাপ্ত গাছ না থাকে, তবে পানি পাহাড় থেকে দ্রুত নেমে এসে আকস্মিক বন্যা ও ভূমিধ্বস সৃষ্টি করে। বাংলাদেশে ২০২০ সালে চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলে ভূমিধসের প্রধান কারণগুলোর একটি ছিল বন উজাড় এবং পাহাড় কাটা। আবার গাছ বৃষ্টিপাত বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। গাছের পাতার বাষ্পীভবনের ফলে বায়ুমণ্ডলে জলীয় বাষ্প বৃদ্ধি পায়, যা মেঘ তৈরি করে বৃষ্টি বর্ষণে সহায়তা করে। ফলে ভূপৃষ্ঠ শীতল থাকে এবং কৃষিকাজ উপযোগী হয়।

পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় বনভূমির পরিমাণ গুরুত্বপূর্ণ। একটি দেশের মোট ভূখণ্ডের অন্তত ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন বলে পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের অভিমত। কিন্তু বাংলাদেশে সরকারি হিসাব অনুযায়ী বনভূমির পরিমাণ প্রায় ১৬ শতাংশ, আর বাস্তবে তা ১১ শতাংশেরও কম। প্রয়োজনীয় বনভূমি না থাকায় দিনে দিনে কার্বন-ডাই-অক্সাইড এবং অন্যান্য গ্রীনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে বৈশ্বিক উষ্ণতা ত্বরান্বিত হচ্ছে। এর ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, উপকূলীয় এলাকা লবণাক্ত হচ্ছে, কৃষিজমি অকৃষিযোগ্য হয়ে পড়ছে, পানির উৎস সংকুচিত হয়ে পড়ছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২১০০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বর্তমানের তুলনায় প্রায় ১ মিটার বৃদ্ধি পেতে পারে, যা বাংলাদেশের উপকূলের বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে ডুবিয়ে দিতে পারে।

গাছপালা প্রাণীদের আশ্রয়স্থল হিসেবেও অপরিহার্য। বিশ্বের জীববৈচিত্র্যের প্রায় ৮০ শতাংশই বনভূমি নির্ভর। বন উজাড় হলে শুধু পাখি, কীটপতঙ্গ ও বন্যপ্রাণী নয়, পুরো খাদ্যচক্র ভেঙে পড়ে প্রাকৃতিক পরিবেশব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়। বাংলাদেশে গত দুই দশকে প্রাকৃতিক বনাঞ্চল প্রায় ২০ শতাংশ কমে গেছে, যার ফলে দোয়েল, শালিক, বাবুইসহ বহু স্থানীয় পাখির সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। আবার মৌমাছির সংখ্যা কমে গেলে ফসলের পরাগায়ন ব্যাহত হয় এবং কৃষিজ উৎপাদন গড়ে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য গাছ রোপণ ও সংরক্ষণ অত্যন্ত জরুরি।

কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, গাছ আমাদের জীবনধারণের জন্য যে অপরিসীম উপকার করে, আমরা তার বিপরীতে তাকে নিরন্তর ধ্বংস করছি। বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ২০ থেকে ২৫ হাজার হেক্টর বনভূমি উজাড় হচ্ছে বলে পরিবেশ অধিদপ্তরের রিপোর্টে উল্লেখ রয়েছে। অবকাঠামো নির্মাণ, চাষের জমি সম্প্রসারণ, সড়ক প্রশস্ত করা, ইটভাটা স্থাপন, কাঠের চাহিদা বৃদ্ধি এবং জ্বালানির জন্য গাছ কাটাই এর প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। শহরে বিজ্ঞাপন বোর্ড টানাতে গাছের গায়ে পেরেক ঠুকে বা ছিদ্র করে গাছকে শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়, যা ধীরে ধীরে গাছের বৃদ্ধি কমিয়ে তাকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেয়। অনেক ক্ষেত্রে বনভূমি দখল করে অবৈধ বসতি ও শিল্পকারখানা স্থাপন করা হচ্ছে, ফলে জীববৈচিত্র্যের স্বাভাবিক আবাসস্থল বিলীন হয়ে যাচ্ছে। অথচ গাছও একটি জীবন্ত সত্তা, যার প্রাণ আছে, ক্ষত আছে, পুনর্জীবনের প্রয়োজন আছে। প্রাচীন পরিবেশদর্শনে বলা আছে, একটি গাছ কাটা মানে একটি জীবনের শ্বাসরোধ করা; আর আধুনিক বিজ্ঞানও বলছে, একটি পূর্ণবয়স্ক গাছের মৃত্যু মানে বায়ুমণ্ডলে অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ বৃদ্ধি এবং পরিবেশের ভারসাম্য ব্যাহত হওয়া। তাই গাছ ধ্বংস মানে ভবিষ্যৎকে ধ্বংস করা, নিজেকে নিজের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো।

পর্যাপ্ত গাছ না থাকার ফলে দেশে ধীরে ধীরে মরুকরণ বাড়ছে। বিশেষ করে দেশের উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী, নওগাঁ, জয়পুরহাট ও চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ বহু জেলায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতি বছর গড়ে ৩০ থেকে ৪০ সেন্টিমিটার নিচে নেমে যাচ্ছে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব জানায়। একসময় যে অঞ্চলে অল্প গভীরতার নলকূপ বসালেই পানি পাওয়া যেত, আজ সেখানে শত শত ফুট নিচ পর্যন্ত খনন করেও অনেক ক্ষেত্রে পানির নিশ্চয়তা নেই। পানির এ সংকট শুধু মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহারে নয়, কৃষিকাজেও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। যথাসময়ে সেচের পানি না পেলে ধান, গম, সবজি ও ফলের উৎপাদন হ্রাস পায়, যার প্রভাবে বাজারে খাদ্যদ্রব্যের দাম বৃদ্ধি এবং খাদ্য সংকট দেখা দেয়। ফলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষিনির্ভর অর্থনীতি দীর্ঘমেয়াদে চাপে পড়ে যাচ্ছে। তাই পানি ধারণ ও মাটির আর্দ্রতা বজায় রাখতে এবং মরুকরণ প্রতিরোধে বৃহৎ পরিসরে গাছ লাগানো অত্যন্ত জরুরি।

গাছ লাগানো শুধু পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব নয়, এটি মানবিক দায়িত্ব। শিশুদের শৈশব থেকে গাছের প্রতি ভালোবাসা জাগিয়ে তুলতে হবে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃক্ষরোপণ উৎসব হতে পারে, যেমন বার্ষিক ক্রীড়া বা সাংস্কৃতিক উৎসব হয়। সরকার ও ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবকাঠামো নির্মাণের সময় ‘একটি বাড়ি একটি গাছ’, ‘একটি রাস্তা হাজারো ছায়া’ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। নগর পরিকল্পনায় ‘গ্রিন করিডোর’, ‘সবুজ ছাদ’, ‘উল্লম্ব বাগান’ ও ‘পার্ক পুনরুদ্ধার’ প্রকল্প গ্রহণ করা জরুরি।

বৃক্ষরোপণ শুধু চারাগাছ মাটিতে বসিয়ে দেওয়া নয়, বরং পরিচর্যা ও সংরক্ষণের মধ্যেই এর প্রকৃত সফলতা নিহিত। একটি গাছ লাগাতে কয়েক মিনিট সময় লাগলেও, পূর্ণবয়স্ক হতে লাগে পাঁচ থেকে বিশ বছর পর্যন্ত, গাছের প্রজাতি ও পরিবেশগত অবস্থার উপর নির্ভর করে। তাই লাগানো প্রতিটি গাছকে নিয়মিত পানি দেওয়া, আশপাশের মাটি নরম ও আগাছা মুক্ত রাখা, প্রয়োজন হলে বাঁশের খুঁটি দিয়ে সুরক্ষা দেওয়া এবং পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে রক্ষার ব্যবস্থা করা জরুরি। বাংলাদেশে গণবনায়ন কর্মসূচির মাধ্যমে প্রতি বছর লাখো চারা রোপণ করা হলেও, পরিচর্যার অভাবে প্রায় ৪০ শতাংশ চারা প্রথম দুই বছরেই নষ্ট হয়ে যায় বলে পরিবেশ অধিদপ্তর উল্লেখ করেছে। তাই রোপণ ও পরিচর্যার সমন্বিত পরিকল্পনা ছাড়া বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম দীর্ঘস্থায়ী হয় না।

এই পৃথিবী আমাদের একমাত্র বাসস্থান, এবং একে বসবাসের উপযোগী রাখার প্রধান উপায় হলো সবুজের পরিমাণ বৃদ্ধি করা। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব, যেমন অতিরিক্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিধস ও লবণাক্ততা বৃদ্ধি, এসবের বিরুদ্ধে গাছই সবচেয়ে প্রাকৃতিক ও কার্যকর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। বিজ্ঞান বলছে, একটি পূর্ণবয়স্ক গাছ বছরে প্রায় ২১ কেজি কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে এবং পরিবেশে ছায়া, আর্দ্রতা ও শীতলতা সৃষ্টি করে। তাই এখনই প্রয়োজন ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সচেতন, দৃঢ় ও সম্মিলিত উদ্যোগ। গাছ বাঁচলে প্রকৃতি বাঁচবে, প্রকৃতি বাঁচলে মানুষ বাঁচবে, আর মানুষ বাঁচলে টিকে থাকবে সভ্যতা। সবুজ পৃথিবী কেবল নান্দনিক সৌন্দর্যের প্রতীক নয়, এটি প্রাণের নিশ্বাস, জীবনের পরম সহায় এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তা।

লেখক: সিনিয়র কৃষিবিদ, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ও চেয়ারম্যান ডিআপি ফাউন্ডেশন।

ড. রাধেশ্যাম সরকার

০৮ নভেম্বর, ২০২৫,  3:17 PM

news image

গাছ পরিবেশের অকৃত্রিম বন্ধু। মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে গাছ কোনো না কোনো উপায়ে মানবকল্যাণে কাজ করে যায়। পৃথিবীর সামগ্রিক পরিবেশব্যবস্থায় জীববৈচিত্র্য রক্ষা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধ, পানি ও বায়ুর মান নিয়ন্ত্রণ, জলবায়ুকে সহনীয় রাখা এবং খাদ্য ও আশ্রয় সরবরাহে গাছ এক অনন্য অনুষঙ্গ। গাছ প্রকৃতির সেই মৌন ভৃত্য, যে প্রতিদানে কিছুই চায় না, অথচ নিরলসভাবে জীবনকে টিকিয়ে রাখে। বৃক্ষরাজি ও প্রাণীকুল একে অপরের পরিপূরক। এই সম্পর্ক ভেঙে গেলে পৃথিবীর পরিবেশব্যবস্থা ভেঙে পড়বে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে মানবসভ্যতা।

গাছের মূল ভূমিকা হলো বায়ুমণ্ডলের কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে অক্সিজেন উৎপাদন করা। পৃথিবীর প্রাণীকুলের টিকে থাকার জন্য এই অক্সিজেন অনন্য ও অপরিহার্য। বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে, একটি পূর্ণবয়স্ক গাছ প্রতিদিন প্রায় ২২ কেজি কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে এবং প্রায় ১৮ থেকে ২০ জন মানুষের দৈনন্দিন অক্সিজেন সরবরাহ করতে সক্ষম হয়। আবার অনেক গবেষণা অনুযায়ী একটি মাঝারি আকারের সবজি গাছ প্রায় তিন মাসে তিনজন মানুষের অক্সিজেনের চাহিদা পূরণ করতে পারে। অর্থাৎ গাছ একদিকে বায়ুকে বিশুদ্ধ রাখে, অন্যদিকে অতিরিক্ত গ্রীনহাউস গ্যাস কমিয়ে বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। বিশ্বের মোট কার্বন নিঃসরণের অন্তত ২৫ শতাংশ শোষণ করে বিশ্বের বনাঞ্চল। সুতরাং গাছ প্রকৃতির বায়ুফিল্টার, যা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অপরিসীম ভূমিকা পালন করে।

গাছ অতিরিক্ত তাপমাত্রা শোষণ করে পরিবেশকে শীতল রাখে। শহর এলাকায় যেখানে কংক্রিটের দেয়াল, লোহা ও কাচের আধিক্য, সেখানে তাপমাত্রা গ্রাম অঞ্চলের তুলনায় ৩ থেকে ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেশি হয়ে থাকে। একে "আরবান হিট আইল্যান্ড ইফেক্ট" বলা হয়। শহরে যদি পর্যাপ্ত গাছ লাগানো যায়, ছায়ানিবিড় রাস্তা তৈরি হয়, তবে তাপমাত্রা স্বাভাবিক হয়ে মানুষের বসবাস আরামদায়ক হয়। বিশ্বব্যাপী অনেক শহরে সড়কের দুই পাশে গাছ রোপণ করে তাপমাত্রা গড়ে ৫ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে।

গাছ শুধু বায়ু নয়, পানি প্রবাহও নিয়ন্ত্রণ করে। গাছের শিকড় মাটি শক্ত করে ধ্বস, ভাঙ্গন এবং বৃষ্টির পানি ধারণে সহায়তা করে। যদি পর্যাপ্ত গাছ না থাকে, তবে পানি পাহাড় থেকে দ্রুত নেমে এসে আকস্মিক বন্যা ও ভূমিধ্বস সৃষ্টি করে। বাংলাদেশে ২০২০ সালে চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলে ভূমিধসের প্রধান কারণগুলোর একটি ছিল বন উজাড় এবং পাহাড় কাটা। আবার গাছ বৃষ্টিপাত বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। গাছের পাতার বাষ্পীভবনের ফলে বায়ুমণ্ডলে জলীয় বাষ্প বৃদ্ধি পায়, যা মেঘ তৈরি করে বৃষ্টি বর্ষণে সহায়তা করে। ফলে ভূপৃষ্ঠ শীতল থাকে এবং কৃষিকাজ উপযোগী হয়।

পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় বনভূমির পরিমাণ গুরুত্বপূর্ণ। একটি দেশের মোট ভূখণ্ডের অন্তত ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন বলে পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের অভিমত। কিন্তু বাংলাদেশে সরকারি হিসাব অনুযায়ী বনভূমির পরিমাণ প্রায় ১৬ শতাংশ, আর বাস্তবে তা ১১ শতাংশেরও কম। প্রয়োজনীয় বনভূমি না থাকায় দিনে দিনে কার্বন-ডাই-অক্সাইড এবং অন্যান্য গ্রীনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে বৈশ্বিক উষ্ণতা ত্বরান্বিত হচ্ছে। এর ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, উপকূলীয় এলাকা লবণাক্ত হচ্ছে, কৃষিজমি অকৃষিযোগ্য হয়ে পড়ছে, পানির উৎস সংকুচিত হয়ে পড়ছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২১০০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বর্তমানের তুলনায় প্রায় ১ মিটার বৃদ্ধি পেতে পারে, যা বাংলাদেশের উপকূলের বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে ডুবিয়ে দিতে পারে।

গাছপালা প্রাণীদের আশ্রয়স্থল হিসেবেও অপরিহার্য। বিশ্বের জীববৈচিত্র্যের প্রায় ৮০ শতাংশই বনভূমি নির্ভর। বন উজাড় হলে শুধু পাখি, কীটপতঙ্গ ও বন্যপ্রাণী নয়, পুরো খাদ্যচক্র ভেঙে পড়ে প্রাকৃতিক পরিবেশব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়। বাংলাদেশে গত দুই দশকে প্রাকৃতিক বনাঞ্চল প্রায় ২০ শতাংশ কমে গেছে, যার ফলে দোয়েল, শালিক, বাবুইসহ বহু স্থানীয় পাখির সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। আবার মৌমাছির সংখ্যা কমে গেলে ফসলের পরাগায়ন ব্যাহত হয় এবং কৃষিজ উৎপাদন গড়ে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য গাছ রোপণ ও সংরক্ষণ অত্যন্ত জরুরি।

কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, গাছ আমাদের জীবনধারণের জন্য যে অপরিসীম উপকার করে, আমরা তার বিপরীতে তাকে নিরন্তর ধ্বংস করছি। বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ২০ থেকে ২৫ হাজার হেক্টর বনভূমি উজাড় হচ্ছে বলে পরিবেশ অধিদপ্তরের রিপোর্টে উল্লেখ রয়েছে। অবকাঠামো নির্মাণ, চাষের জমি সম্প্রসারণ, সড়ক প্রশস্ত করা, ইটভাটা স্থাপন, কাঠের চাহিদা বৃদ্ধি এবং জ্বালানির জন্য গাছ কাটাই এর প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। শহরে বিজ্ঞাপন বোর্ড টানাতে গাছের গায়ে পেরেক ঠুকে বা ছিদ্র করে গাছকে শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়, যা ধীরে ধীরে গাছের বৃদ্ধি কমিয়ে তাকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেয়। অনেক ক্ষেত্রে বনভূমি দখল করে অবৈধ বসতি ও শিল্পকারখানা স্থাপন করা হচ্ছে, ফলে জীববৈচিত্র্যের স্বাভাবিক আবাসস্থল বিলীন হয়ে যাচ্ছে। অথচ গাছও একটি জীবন্ত সত্তা, যার প্রাণ আছে, ক্ষত আছে, পুনর্জীবনের প্রয়োজন আছে। প্রাচীন পরিবেশদর্শনে বলা আছে, একটি গাছ কাটা মানে একটি জীবনের শ্বাসরোধ করা; আর আধুনিক বিজ্ঞানও বলছে, একটি পূর্ণবয়স্ক গাছের মৃত্যু মানে বায়ুমণ্ডলে অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ বৃদ্ধি এবং পরিবেশের ভারসাম্য ব্যাহত হওয়া। তাই গাছ ধ্বংস মানে ভবিষ্যৎকে ধ্বংস করা, নিজেকে নিজের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো।

পর্যাপ্ত গাছ না থাকার ফলে দেশে ধীরে ধীরে মরুকরণ বাড়ছে। বিশেষ করে দেশের উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী, নওগাঁ, জয়পুরহাট ও চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ বহু জেলায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতি বছর গড়ে ৩০ থেকে ৪০ সেন্টিমিটার নিচে নেমে যাচ্ছে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব জানায়। একসময় যে অঞ্চলে অল্প গভীরতার নলকূপ বসালেই পানি পাওয়া যেত, আজ সেখানে শত শত ফুট নিচ পর্যন্ত খনন করেও অনেক ক্ষেত্রে পানির নিশ্চয়তা নেই। পানির এ সংকট শুধু মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহারে নয়, কৃষিকাজেও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। যথাসময়ে সেচের পানি না পেলে ধান, গম, সবজি ও ফলের উৎপাদন হ্রাস পায়, যার প্রভাবে বাজারে খাদ্যদ্রব্যের দাম বৃদ্ধি এবং খাদ্য সংকট দেখা দেয়। ফলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষিনির্ভর অর্থনীতি দীর্ঘমেয়াদে চাপে পড়ে যাচ্ছে। তাই পানি ধারণ ও মাটির আর্দ্রতা বজায় রাখতে এবং মরুকরণ প্রতিরোধে বৃহৎ পরিসরে গাছ লাগানো অত্যন্ত জরুরি।

গাছ লাগানো শুধু পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব নয়, এটি মানবিক দায়িত্ব। শিশুদের শৈশব থেকে গাছের প্রতি ভালোবাসা জাগিয়ে তুলতে হবে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃক্ষরোপণ উৎসব হতে পারে, যেমন বার্ষিক ক্রীড়া বা সাংস্কৃতিক উৎসব হয়। সরকার ও ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবকাঠামো নির্মাণের সময় ‘একটি বাড়ি একটি গাছ’, ‘একটি রাস্তা হাজারো ছায়া’ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। নগর পরিকল্পনায় ‘গ্রিন করিডোর’, ‘সবুজ ছাদ’, ‘উল্লম্ব বাগান’ ও ‘পার্ক পুনরুদ্ধার’ প্রকল্প গ্রহণ করা জরুরি।

বৃক্ষরোপণ শুধু চারাগাছ মাটিতে বসিয়ে দেওয়া নয়, বরং পরিচর্যা ও সংরক্ষণের মধ্যেই এর প্রকৃত সফলতা নিহিত। একটি গাছ লাগাতে কয়েক মিনিট সময় লাগলেও, পূর্ণবয়স্ক হতে লাগে পাঁচ থেকে বিশ বছর পর্যন্ত, গাছের প্রজাতি ও পরিবেশগত অবস্থার উপর নির্ভর করে। তাই লাগানো প্রতিটি গাছকে নিয়মিত পানি দেওয়া, আশপাশের মাটি নরম ও আগাছা মুক্ত রাখা, প্রয়োজন হলে বাঁশের খুঁটি দিয়ে সুরক্ষা দেওয়া এবং পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে রক্ষার ব্যবস্থা করা জরুরি। বাংলাদেশে গণবনায়ন কর্মসূচির মাধ্যমে প্রতি বছর লাখো চারা রোপণ করা হলেও, পরিচর্যার অভাবে প্রায় ৪০ শতাংশ চারা প্রথম দুই বছরেই নষ্ট হয়ে যায় বলে পরিবেশ অধিদপ্তর উল্লেখ করেছে। তাই রোপণ ও পরিচর্যার সমন্বিত পরিকল্পনা ছাড়া বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম দীর্ঘস্থায়ী হয় না।

এই পৃথিবী আমাদের একমাত্র বাসস্থান, এবং একে বসবাসের উপযোগী রাখার প্রধান উপায় হলো সবুজের পরিমাণ বৃদ্ধি করা। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব, যেমন অতিরিক্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিধস ও লবণাক্ততা বৃদ্ধি, এসবের বিরুদ্ধে গাছই সবচেয়ে প্রাকৃতিক ও কার্যকর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। বিজ্ঞান বলছে, একটি পূর্ণবয়স্ক গাছ বছরে প্রায় ২১ কেজি কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে এবং পরিবেশে ছায়া, আর্দ্রতা ও শীতলতা সৃষ্টি করে। তাই এখনই প্রয়োজন ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সচেতন, দৃঢ় ও সম্মিলিত উদ্যোগ। গাছ বাঁচলে প্রকৃতি বাঁচবে, প্রকৃতি বাঁচলে মানুষ বাঁচবে, আর মানুষ বাঁচলে টিকে থাকবে সভ্যতা। সবুজ পৃথিবী কেবল নান্দনিক সৌন্দর্যের প্রতীক নয়, এটি প্রাণের নিশ্বাস, জীবনের পরম সহায় এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তা।

লেখক: সিনিয়র কৃষিবিদ, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ও চেয়ারম্যান ডিআপি ফাউন্ডেশন।