CKEditor 5 Sample
ঢাকা ২০ নভেম্বর, ২০২৫

সম্মান চেয়ারে নয়, ব্যবহারে: অবসরজীবনের বাস্তবতা

#
news image

চাকরি মানে শুধু নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন নয়; এটি এক দীর্ঘ মানবিক যাত্রা, যেখানে প্রতিটি দিন, প্রতিটি আচরণ, প্রতিটি সম্পর্ক আমাদের ভবিষ্যৎ জীবনের প্রতিচ্ছবি গড়ে তোলে। কর্মজীবনে আমরা যেমন ব্যবহার করি, অবসরজীবনে সেই ব্যবহারের প্রতিফলনই ফিরে আসে সম্মান বা অবহেলার রূপে। কেউ ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার স্মৃতিতে বাঁচেন, কেউ আবার অনুশোচনার বোঝা নিয়ে নিঃশব্দ একাকীত্বে হারিয়ে যান। জীবনের এই অমোঘ সত্য আমাদের মনে করিয়ে দেয় সম্মান আসলে চেয়ারে নয়, আচরণে; কারণ অবসরজীবনের প্রকৃত প্রাপ্তি নির্ভর করে কর্মজীবনের ব্যবহার ও মানবিকতার উপর। এই প্রবন্ধে সেই সত্যটিই আলোচিত হয়েছে, যেখানে দেখা যায়, চাকরি জীবনে সদাচরণই অবসরজীবনের আসল সম্পদ।

চাকরিতে অপ্রয়োজনীয় কঠোরতা, অহংকার, অবজ্ঞা বা তুচ্ছ আচরণ শুধু সাময়িক প্রভাব ফেলে না; এগুলি ধীরে ধীরে মানুষকে সমাজের দৃষ্টিতে একক এবং বিচ্ছিন্ন করে তোলে। একটি তীক্ষ্ণ কথা, একটি কটু চাহনি, বা অন্যের প্রতি অহংকারী মনোভাব এসবের প্রতিটি অংশ আমাদের সামাজিক পরিচয়কে ক্ষতিগ্রস্ত করে। চাকরি শেষের পরে, যখন মানুষ জীবনের অর্জন এবং অভাবের হিসাব করে, তখন এ ধরনের নেতিবাচক আচরণই তার চারপাশের মানুষের কাছে দূরত্ব ও অবহেলার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অনেক সময় মানুষ সমস্ত পদ, প্রাপ্য সম্মান এবং বস্তুগত সুবিধা পেলেও, যদি আচরণে অন্যদের প্রতি শ্রদ্ধা না থাকে, তখন সে একাকীত্ব ও অনুশোচনার বোঝা নিয়ে বাঁচে।

দুর্ব্যবহারের মূল কারণগুলো প্রায়ই মানুষের ব্যক্তিগত মনস্তত্ত্ব এবং মানসিক অবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত। ক্ষমতার অহংকার অনেক সময় মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করে। যারা উচ্চ পদে পৌঁছে, তারা প্রায়ই মনে করেন তারা সবার চেয়ে বড় এবং শক্তিশালী। এই ভ্রান্ত ধারণা থেকে জন্ম নেয় তুচ্ছ অবজ্ঞা, কৃপণতা এবং অপমানমূলক ব্যবহার। যেমন জনাব করিম, একজন সরকারি কর্মকর্তার পদে থাকা অবস্থায় অধীনস্তদের তুচ্ছ কারণে অপমান করতেন। কিন্তু অবসরের পর দেখা যায়, তার কোনও সহকর্মী তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে না। একসময় নিজেই বলেছিলেন, “চেয়ারটা ছিল আমার, সম্মানটা নয়। এখন বুঝি।”

এছাড়া, নিজের জ্ঞান, পদবী বা কৌশলের প্রতি অহংকার মানুষকে অন্যদের মতামতকে অবজ্ঞা করতে প্ররোচিত করে। অনেকেই সহকর্মীদের পরামর্শকে পাত্তা না দিয়ে কেবল নিজের মত চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। এমন আচরণের ফলে উৎপাদনশীলতা কমে যায় এবং নেতৃত্বের দক্ষতায় সন্দেহ দেখা দেয়। উদাহরণস্বরূপ, শাহীন সাহেব প্রমোশন পাওয়ার পর তার আচরণে পরিবর্তন আনেন, নিজের মতামতই সর্বোচ্চ মনে করতে শুরু করেন। এতে তার টীমের কার্যক্ষমতা কমে যায় এবং অবশেষে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তার নেতৃত্বের প্রতি প্রশ্ন তোলে। সহানুভূতির অভাবও দুর্ব্যবহারের এক বড় কারণ। মানবিক জীবনে সবচেয়ে মূল্যবান গুণ হলো অন্যের অবস্থাকে বোঝার ক্ষমতা। যার ভেতরে সহানুভূতি নেই, সে চাইলে অন্যদের ভালোবাসা ও সহমর্মিতা পায় না। মহসিন সাহেব এমন একজন ছিলেন, যিনি এক কর্মচারীর অসুস্থতার প্রতি সহানুভূতি না দেখিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করতেন।

কিছুদিন পর নিজেই এক দুর্ঘটনার শিকার হলে, তার কোনো সহকর্মী পাশে দাঁড়ায়নি। এ থেকে বোঝা যায়, সময় সবকিছু বিচার করে দেয় এবং যে আচরণ অন্যের প্রতি অবহেলা প্রকাশ করে, তার ফল দীর্ঘমেয়াদী।অন্যদিকে, ভেতরে নিরাপত্তাহীনতা অনুভূত মানুষ প্রায়ই বাহ্যিক কঠোরতা দেখায়। তারা মনে করে, নরম বা নম্র হলে সবাই তাকে দুর্বল মনে করবে। উদাহরণস্বরূপ, রাশেদ সাহেব প্রমোশন পাওয়ার পর আচরণে কৃত্রিম কঠোরতা আনেন, মুখে সবসময় কঠিন কথা বলতেন। কিন্তু কাজের চাপ বাড়লে কেউ তার পাশে দাঁড়ায়নি। একসময় সম্পর্কহীনতা ও মানসিক চাপের কারণে তিনি মানসিক সমস্যায় ভুগতে থাকেন।

চাকরিতে দুর্ব্যবহার কখনও পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে যায় না; এটি মানুষের মনে সবসময় রয়ে যায়, এক ধরনের অদৃশ্য ছাপের মতো, যা সময়ের সঙ্গে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই স্মৃতি থাকে উভয় পক্ষেরই—যে পক্ষে দুর্ব্যবহার করা হয়েছে, তারও মনে; এবং যার বিরুদ্ধে তা করা হয়েছে, তারও মনে। কর্মজীবনে যিনি অন্যদের প্রতি অসম্মান, রূঢ়তা বা অহংকার প্রদর্শন করেছেন, অবসরজীবনে প্রায়শই তিনিই সেই আচরণের প্রতিফলন পান সমাজ থেকে। তখন মানুষ তাকে আর শ্রদ্ধার চোখে নয়, বরং দূরত্ব এবং অবহেলার দৃষ্টিতে দেখে। পেনশন, সম্পদ বা পদবী থাকা সত্ত্বেও মন তখন খালি থাকে, যেন কিছুই পূর্ণ করতে পারছে না।

ফোনের ঘণ্টা বাজে না, বারান্দায় কেউ আসে না, আর একসময় যাদের সঙ্গে প্রতিদিন যোগাযোগ ছিল, তারা এখন আর খোঁজ নেয় না। অনেক প্রবীণ তাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, “যাদের ছোট করতাম, আজ তাদের ছোট ছোট ভালোবাসাই চাই।” এই একটি বাক্যই জীবনের বাস্তব শিক্ষার পরিচয় দেয়—চেয়ারের ক্ষমতা ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু আচরণের ছাপ চিরস্থায়ী। অন্যদিকে, যারা চাকরি জীবনে সদাচরণ, নম্রতা, সহানুভূতি এবং আন্তরিক ব্যবহার বজায় রাখেন, তাদের অবসরজীবনে চারপাশে ঘিরে থাকে প্রকৃত শ্রদ্ধা, আন্তরিক ভালোবাসা এবং সমর্থনের দৃঢ় বৃত্ত। প্রাক্তন সহকর্মীরা নিয়মিত তাদের খোঁজ নেন, উৎসব ও পার্বণ, বিশেষ দিন এবং জীবনের নানা ছোট ছোট মুহূর্তেও কেউ না কেউ পাশে দাঁড়ায়। ফলে তাদের মানসিক প্রশান্তি বজায় থাকে, মন শান্ত থাকে এবং জীবনের শেষ পর্যায়ে তারা গভীর আত্মতৃপ্তি অনুভব করেন। এটি স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, আচরণই মানুষের জীবনে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ, যা শুধু সাময়িক সম্পর্ক নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদী সামাজিক মর্যাদা, বিশ্বাস ও আন্তরিকতার ভিত্তিও তৈরি করে।

সমাজ ও ধর্মীয় শিক্ষার আলোও এই সত্যকে সমর্থন করে। ইসলামে বলা হয়েছে, "তোমার ব্যবহারে তোমার ঈমানের প্রতিফলন ঘটে।" হিন্দু ধর্মে রয়েছে, "অহংকারই পতনের মূল।" বৌদ্ধ ধর্মে শিখানো হয়েছে, "মানুষকে পূর্ণ করে তার আচরণ।" সব ধর্মই মানুষের নৈতিক আচরণকে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক হিসেবে বিবেচনা করে।

অবশেষে জীবনের শেষ অধ্যায় কেমন হবে তা অনেকটাই নির্ভর করে আমরা কর্মজীবনে কেমন আচরণ করেছি তার উপর। অফিসের চেয়ার, পদমর্যাদা বা আর্থিক সমৃদ্ধি একদিন হারিয়ে যায়, কিন্তু মানুষের প্রতি আমাদের ব্যবহার, আমাদের কথাবার্তা, আচরণ ও সহানুভূতির স্মৃতি থেকে যায় দীর্ঘদিন। সেই স্মৃতিই নির্ধারণ করে অবসরজীবনের আনন্দ বা নিঃসঙ্গতা। সম্মান কখনো চেয়ার থেকে জন্ম নেয় না, জন্ম নেয় আচরণের গভীরতায়, বিনয় আর শ্রদ্ধাবোধের ধারাবাহিকতায়। চাকরি শেষ হলেও মানুষ টিকে থাকে তার ব্যবহারের ছাপেই, সেই ছাপ কখনো ভালোবাসার সুবাস হয়ে ফিরে আসে, কখনো তিক্ত অভিজ্ঞতার দহন হয়ে মনকে পোড়ায়। আর যদি সেই স্মৃতি হয় কঠোরতা ও অবহেলার, তবে অবসরজীবনও হয়ে ওঠে নিঃসঙ্গ ও বিষাদময়। তাই এখন থেকেই প্রয়োজন বিনয়, সহানুভূতি, শ্রদ্ধা ও সদাচরণের চর্চা, কারণ এই গুণগুলিই শেষ পর্যন্ত গড়ে তোলে অবসরজীবনের প্রকৃত শান্তি, ভালোবাসা এবং আত্মতৃপ্তির জায়গা। লেখক: কৃষিবিদ, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ও চেয়ারম্যান, ডিআরপি ফাউন্ডেশন।

ড. রাধেশ্যাম সরকার

০৪ নভেম্বর, ২০২৫,  4:08 PM

news image

চাকরি মানে শুধু নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন নয়; এটি এক দীর্ঘ মানবিক যাত্রা, যেখানে প্রতিটি দিন, প্রতিটি আচরণ, প্রতিটি সম্পর্ক আমাদের ভবিষ্যৎ জীবনের প্রতিচ্ছবি গড়ে তোলে। কর্মজীবনে আমরা যেমন ব্যবহার করি, অবসরজীবনে সেই ব্যবহারের প্রতিফলনই ফিরে আসে সম্মান বা অবহেলার রূপে। কেউ ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার স্মৃতিতে বাঁচেন, কেউ আবার অনুশোচনার বোঝা নিয়ে নিঃশব্দ একাকীত্বে হারিয়ে যান। জীবনের এই অমোঘ সত্য আমাদের মনে করিয়ে দেয় সম্মান আসলে চেয়ারে নয়, আচরণে; কারণ অবসরজীবনের প্রকৃত প্রাপ্তি নির্ভর করে কর্মজীবনের ব্যবহার ও মানবিকতার উপর। এই প্রবন্ধে সেই সত্যটিই আলোচিত হয়েছে, যেখানে দেখা যায়, চাকরি জীবনে সদাচরণই অবসরজীবনের আসল সম্পদ।

চাকরিতে অপ্রয়োজনীয় কঠোরতা, অহংকার, অবজ্ঞা বা তুচ্ছ আচরণ শুধু সাময়িক প্রভাব ফেলে না; এগুলি ধীরে ধীরে মানুষকে সমাজের দৃষ্টিতে একক এবং বিচ্ছিন্ন করে তোলে। একটি তীক্ষ্ণ কথা, একটি কটু চাহনি, বা অন্যের প্রতি অহংকারী মনোভাব এসবের প্রতিটি অংশ আমাদের সামাজিক পরিচয়কে ক্ষতিগ্রস্ত করে। চাকরি শেষের পরে, যখন মানুষ জীবনের অর্জন এবং অভাবের হিসাব করে, তখন এ ধরনের নেতিবাচক আচরণই তার চারপাশের মানুষের কাছে দূরত্ব ও অবহেলার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অনেক সময় মানুষ সমস্ত পদ, প্রাপ্য সম্মান এবং বস্তুগত সুবিধা পেলেও, যদি আচরণে অন্যদের প্রতি শ্রদ্ধা না থাকে, তখন সে একাকীত্ব ও অনুশোচনার বোঝা নিয়ে বাঁচে।

দুর্ব্যবহারের মূল কারণগুলো প্রায়ই মানুষের ব্যক্তিগত মনস্তত্ত্ব এবং মানসিক অবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত। ক্ষমতার অহংকার অনেক সময় মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করে। যারা উচ্চ পদে পৌঁছে, তারা প্রায়ই মনে করেন তারা সবার চেয়ে বড় এবং শক্তিশালী। এই ভ্রান্ত ধারণা থেকে জন্ম নেয় তুচ্ছ অবজ্ঞা, কৃপণতা এবং অপমানমূলক ব্যবহার। যেমন জনাব করিম, একজন সরকারি কর্মকর্তার পদে থাকা অবস্থায় অধীনস্তদের তুচ্ছ কারণে অপমান করতেন। কিন্তু অবসরের পর দেখা যায়, তার কোনও সহকর্মী তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে না। একসময় নিজেই বলেছিলেন, “চেয়ারটা ছিল আমার, সম্মানটা নয়। এখন বুঝি।”

এছাড়া, নিজের জ্ঞান, পদবী বা কৌশলের প্রতি অহংকার মানুষকে অন্যদের মতামতকে অবজ্ঞা করতে প্ররোচিত করে। অনেকেই সহকর্মীদের পরামর্শকে পাত্তা না দিয়ে কেবল নিজের মত চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। এমন আচরণের ফলে উৎপাদনশীলতা কমে যায় এবং নেতৃত্বের দক্ষতায় সন্দেহ দেখা দেয়। উদাহরণস্বরূপ, শাহীন সাহেব প্রমোশন পাওয়ার পর তার আচরণে পরিবর্তন আনেন, নিজের মতামতই সর্বোচ্চ মনে করতে শুরু করেন। এতে তার টীমের কার্যক্ষমতা কমে যায় এবং অবশেষে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তার নেতৃত্বের প্রতি প্রশ্ন তোলে। সহানুভূতির অভাবও দুর্ব্যবহারের এক বড় কারণ। মানবিক জীবনে সবচেয়ে মূল্যবান গুণ হলো অন্যের অবস্থাকে বোঝার ক্ষমতা। যার ভেতরে সহানুভূতি নেই, সে চাইলে অন্যদের ভালোবাসা ও সহমর্মিতা পায় না। মহসিন সাহেব এমন একজন ছিলেন, যিনি এক কর্মচারীর অসুস্থতার প্রতি সহানুভূতি না দেখিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করতেন।

কিছুদিন পর নিজেই এক দুর্ঘটনার শিকার হলে, তার কোনো সহকর্মী পাশে দাঁড়ায়নি। এ থেকে বোঝা যায়, সময় সবকিছু বিচার করে দেয় এবং যে আচরণ অন্যের প্রতি অবহেলা প্রকাশ করে, তার ফল দীর্ঘমেয়াদী।অন্যদিকে, ভেতরে নিরাপত্তাহীনতা অনুভূত মানুষ প্রায়ই বাহ্যিক কঠোরতা দেখায়। তারা মনে করে, নরম বা নম্র হলে সবাই তাকে দুর্বল মনে করবে। উদাহরণস্বরূপ, রাশেদ সাহেব প্রমোশন পাওয়ার পর আচরণে কৃত্রিম কঠোরতা আনেন, মুখে সবসময় কঠিন কথা বলতেন। কিন্তু কাজের চাপ বাড়লে কেউ তার পাশে দাঁড়ায়নি। একসময় সম্পর্কহীনতা ও মানসিক চাপের কারণে তিনি মানসিক সমস্যায় ভুগতে থাকেন।

চাকরিতে দুর্ব্যবহার কখনও পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে যায় না; এটি মানুষের মনে সবসময় রয়ে যায়, এক ধরনের অদৃশ্য ছাপের মতো, যা সময়ের সঙ্গে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই স্মৃতি থাকে উভয় পক্ষেরই—যে পক্ষে দুর্ব্যবহার করা হয়েছে, তারও মনে; এবং যার বিরুদ্ধে তা করা হয়েছে, তারও মনে। কর্মজীবনে যিনি অন্যদের প্রতি অসম্মান, রূঢ়তা বা অহংকার প্রদর্শন করেছেন, অবসরজীবনে প্রায়শই তিনিই সেই আচরণের প্রতিফলন পান সমাজ থেকে। তখন মানুষ তাকে আর শ্রদ্ধার চোখে নয়, বরং দূরত্ব এবং অবহেলার দৃষ্টিতে দেখে। পেনশন, সম্পদ বা পদবী থাকা সত্ত্বেও মন তখন খালি থাকে, যেন কিছুই পূর্ণ করতে পারছে না।

ফোনের ঘণ্টা বাজে না, বারান্দায় কেউ আসে না, আর একসময় যাদের সঙ্গে প্রতিদিন যোগাযোগ ছিল, তারা এখন আর খোঁজ নেয় না। অনেক প্রবীণ তাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, “যাদের ছোট করতাম, আজ তাদের ছোট ছোট ভালোবাসাই চাই।” এই একটি বাক্যই জীবনের বাস্তব শিক্ষার পরিচয় দেয়—চেয়ারের ক্ষমতা ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু আচরণের ছাপ চিরস্থায়ী। অন্যদিকে, যারা চাকরি জীবনে সদাচরণ, নম্রতা, সহানুভূতি এবং আন্তরিক ব্যবহার বজায় রাখেন, তাদের অবসরজীবনে চারপাশে ঘিরে থাকে প্রকৃত শ্রদ্ধা, আন্তরিক ভালোবাসা এবং সমর্থনের দৃঢ় বৃত্ত। প্রাক্তন সহকর্মীরা নিয়মিত তাদের খোঁজ নেন, উৎসব ও পার্বণ, বিশেষ দিন এবং জীবনের নানা ছোট ছোট মুহূর্তেও কেউ না কেউ পাশে দাঁড়ায়। ফলে তাদের মানসিক প্রশান্তি বজায় থাকে, মন শান্ত থাকে এবং জীবনের শেষ পর্যায়ে তারা গভীর আত্মতৃপ্তি অনুভব করেন। এটি স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, আচরণই মানুষের জীবনে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ, যা শুধু সাময়িক সম্পর্ক নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদী সামাজিক মর্যাদা, বিশ্বাস ও আন্তরিকতার ভিত্তিও তৈরি করে।

সমাজ ও ধর্মীয় শিক্ষার আলোও এই সত্যকে সমর্থন করে। ইসলামে বলা হয়েছে, "তোমার ব্যবহারে তোমার ঈমানের প্রতিফলন ঘটে।" হিন্দু ধর্মে রয়েছে, "অহংকারই পতনের মূল।" বৌদ্ধ ধর্মে শিখানো হয়েছে, "মানুষকে পূর্ণ করে তার আচরণ।" সব ধর্মই মানুষের নৈতিক আচরণকে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক হিসেবে বিবেচনা করে।

অবশেষে জীবনের শেষ অধ্যায় কেমন হবে তা অনেকটাই নির্ভর করে আমরা কর্মজীবনে কেমন আচরণ করেছি তার উপর। অফিসের চেয়ার, পদমর্যাদা বা আর্থিক সমৃদ্ধি একদিন হারিয়ে যায়, কিন্তু মানুষের প্রতি আমাদের ব্যবহার, আমাদের কথাবার্তা, আচরণ ও সহানুভূতির স্মৃতি থেকে যায় দীর্ঘদিন। সেই স্মৃতিই নির্ধারণ করে অবসরজীবনের আনন্দ বা নিঃসঙ্গতা। সম্মান কখনো চেয়ার থেকে জন্ম নেয় না, জন্ম নেয় আচরণের গভীরতায়, বিনয় আর শ্রদ্ধাবোধের ধারাবাহিকতায়। চাকরি শেষ হলেও মানুষ টিকে থাকে তার ব্যবহারের ছাপেই, সেই ছাপ কখনো ভালোবাসার সুবাস হয়ে ফিরে আসে, কখনো তিক্ত অভিজ্ঞতার দহন হয়ে মনকে পোড়ায়। আর যদি সেই স্মৃতি হয় কঠোরতা ও অবহেলার, তবে অবসরজীবনও হয়ে ওঠে নিঃসঙ্গ ও বিষাদময়। তাই এখন থেকেই প্রয়োজন বিনয়, সহানুভূতি, শ্রদ্ধা ও সদাচরণের চর্চা, কারণ এই গুণগুলিই শেষ পর্যন্ত গড়ে তোলে অবসরজীবনের প্রকৃত শান্তি, ভালোবাসা এবং আত্মতৃপ্তির জায়গা। লেখক: কৃষিবিদ, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ও চেয়ারম্যান, ডিআরপি ফাউন্ডেশন।