CKEditor 5 Sample
ঢাকা ২১ নভেম্বর, ২০২৫

অবসরজীবনের একাকীত্ব ও সম্পর্কের টানাপোড়েন।

#
news image

দুপুরের শেষ আলোটি জানালার গায়ে এসে থেমেছে। এক অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ দম্পতি চুপচাপ বসে আছেন বারান্দার চেয়ারে। একসময় সংসারের কোলাহলে মুখর ছিল এই ঘর সন্তানের পড়াশোনা, পরীক্ষার উৎকণ্ঠা, ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা, আর সীমাহীন স্বপ্নের ভিড়। আজ ঘর নিঃশব্দ। চারপাশে ছড়িয়ে আছে অবসর, একাকীত্ব, আর অপ্রাপ্তির দীর্ঘ ছায়া। অবসরপ্রাপ্ত বাবা-মায়ের সবচেয়ে বড় ভয় এখন কেবল একটাই তা হলো সন্তানের সঙ্গে সম্পর্কের শৈথিল্য, এবং সেই সূত্রে বার্ধক্যের নিঃসঙ্গতা ও বিচ্ছিন্নতা। আধুনিক সময়ে এই ভয় কেবল পারিবারিক সংকট নয়, বরং একটি সামাজিক বাস্তবতাও বটে।

মানুষের জীবনে সবচেয়ে প্রিয় ও অবিচ্ছেদ্য সত্তা হলো তার সন্তান। সন্তানকে ঘিরেই পিতা-মাতার পৃথিবী গড়ে ওঠে। তাদের আশা, প্রয়াস, ভালোবাসা, স্বপ্ন আর সংগ্রামের সমস্ত রঙ সেই সন্তানকেন্দ্রিক। সন্তানের হাসিই তাদের দিনের আলো, সন্তানের দুঃখেই তারা অস্থির হয়। নিজের জীবনের ব্যর্থতা ও সীমাবদ্ধতাকে তারা ভুলে যায় যখন সন্তানের সাফল্যের মুখে একটুখানি তৃপ্তির ছায়া দেখতে পায়। সমাজে সন্তান যেন তার পিতা-মাতার স্বপ্নের পরিণতি, তাদের জীবনের সবচেয়ে সার্থক প্রকাশ। প্রতিটি মা-বাবা চায় তাদের সন্তান হোক নিজের চেয়েও যোগ্য, নিজের চেয়ে উচ্চতর, যে পূর্ণ করবে তাদের অসম্পূর্ণ ইচ্ছা ও অপূর্ণ সাধ। সেই আকাঙ্ক্ষার টানে তারা জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে পরিশ্রম করে, নিঃস্বার্থভাবে বিলিয়ে দেয় শ্রম, অর্থ, সময় আর স্নেহের প্রতিটি কণা। কিন্তু যে জীবনটি তারা এত যত্নে, এত ত্যাগে গড়ে তোলে, একদিন সেই সন্তানই নিজের জীবনের ব্যস্ততা, দায়িত্বের জটিলতা, কিংবা সম্পর্কের অগ্রাধিকারের পরিবর্তনের কারণে ধীরে ধীরে দূরে সরে যায়। নিঃশব্দে, অজান্তেই, যেন এক অদৃশ্য দূরত্ব জন্ম নেয় তাদের আপন সম্পর্কের মাঝে।

অবসরের পর পিতামাতা যখন জীবনের গতি থেমে যেতে থাকে, তখন তাদের সবচেয়ে প্রয়োজন হয় সম্পর্কের উষ্ণতা, কিছু সময়, কিছু কথা। কিন্তু তখন সন্তানরা থাকে কর্মব্যস্ত জীবনের কেন্দ্রে। পিতামাতার কাছে এই সময়ে যে প্রত্যাশা থাকে সেটি ভালোবাসার চেয়ে প্রায়ই দায়িত্বের রূপ নেয়।সমাজে প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী পুত্রের কাছেই থাকে পিতামাতার বার্ধক্যের ভরসা। কন্যা বিবাহের পর ‘অন্যের ঘরে’ চলে যায়। এই ধারণা থেকেই পুত্রের উপর দায়িত্বের ভার আরোপ করা হয়। অথচ এই ‘দায়িত্ব’ শব্দটিই অনেক সময় সম্পর্ককে ভারী ও যান্ত্রিক করে তোলে। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, যেসব সম্পর্ক দায়িত্ববোধের বাঁধনে গড়ে ওঠে, সেখানে স্নেহ ও মমতার প্রবাহ কমে যায়; সম্পর্ক হয়ে পড়ে কর্তব্যনির্ভর, উষ্ণতাহীন।

অনেক অবসরপ্রাপ্ত পিতা-মাতা অজান্তেই সন্তানের কাছে এক ধরনের জীবন্ত দাসত্বের প্রত্যাশা করেন। তারা চান, পুত্র যেন প্রতিটি প্রয়োজনে পাশে থাকে, প্রতিটি সংকটে দায়িত্ব নেয়, এবং তাদের জীবনযাপনেও অর্থনৈতিক সহায়তা দেয়। অথচ ভালোবাসা কখনোই হিসাবের বন্ধনে টেকে না। যে সম্পর্ক থেকে একতরফা অনুগত্যের দাবি করা হয়, সেটি ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ে। পুত্ররা অনেক সময় এ ধরনের অঘোষিত দাবির চাপেই মানসিক দূরত্ব তৈরি করে। বিপরীতে, পিতামাতা কন্যার কাছে কোনো প্রত্যাশা রাখেন না। সেই কারণেই কন্যার সামান্য স্নেহ-দর্শনও তাদের অপরিসীম আনন্দ দেয়।

সমাজে প্রায়শই শোনা যায়, “ছেলের বিয়ে হলে ছেলে বউয়ের হয়ে যায়, কিন্তু মেয়ে বিয়ে করলেও কখনো পর হয়ে যায় না।” এই কথাটির গভীরে আছে মানসিক পার্থক্যের এক সূক্ষ্ম সত্য। কন্যার প্রতি পিতামাতার ভালোবাসা নিঃস্বার্থ; তারা মেয়েকে কিছু দিলেও প্রত্যাবর্তনের আশা করে না। কন্যার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যই তাদের আনন্দের উৎস। কিন্তু পুত্রের ক্ষেত্রে ভালোবাসার সঙ্গে জুড়ে যায় প্রত্যাশা, দায়িত্ব, এমনকি আর্থিক হিসাব। ছেলের পড়াশোনা, চাকরি বা ব্যবসায় যে ব্যয় করা হয়েছে, তা অনেকের কাছে একপ্রকার বিনিয়োগের রূপ নেয়। বার্ধক্যে এসে তারা প্রায়ই বলেন, “তোর পিছনে এত খরচ করেছি, বিনিময়ে কী পেলাম?” কিন্তু এই প্রশ্নে সম্পর্কের মাধুর্য ক্ষয় হতে থাকে।  মেয়ের বিয়েতে পিতামাতা যত অর্থ ব্যয় করেন, ততটা কখনোই হিসাব করে দেখেন না। কিন্তু ছেলেকে পড়াশোনার জন্য অল্প কিছু সহায়তা দিলেও সেটির হিসাব মনে রাখেন। এমনকি মেয়ের জামাইকে যতটা সম্মান ও ভালোবাসা দেওয়া হয়, পুত্রবধূ প্রায়ই সেই মর্যাদা পায় না। একথা অস্বীকার করা যায় না যে, আমাদের সমাজে পুত্রবধূর প্রতি আচরণে এখনো সন্দেহ, তুলনা, এবং ঈর্ষার ছায়া রয়ে গেছে। শাশুড়ি অনেক সময় পুত্রবধূর সুখকে নিজের অতীত জীবনের সঙ্গে তুলনা করেন, “আমি পারিনি, তুই পারছিস কেন?” এই অজান্ত প্রতিযোগিতা পুত্রের মানসিক অবস্থাকেও জটিল করে তোলে।

এমন বাস্তবতায় পিতা-মাতা প্রায়ই অনুভব করেন, কন্যা সংসারে থেকেও তাঁদের কাছাকাছি, আর পুত্র এক ছাদের নিচে থেকেও দূরে। পুত্রের প্রতি যে শতভাগ প্রত্যাশা রাখা হয়, সে যদি তার ৭০ শতাংশও পূরণ করে, তবুও অবশিষ্ট ৩০ শতাংশের অভাবটাই চোখে পড়ে। অন্যদিকে, কন্যা যদি সামান্য কিছু খোঁজখবর নেয়, তাতেই মনে হয় সে অনেক কিছু করছে। এই দ্বৈত মানদণ্ডই সম্পর্ককে ভারসাম্যহীন করে তোলে।

একটি সমাজে পিতামাতা ও সন্তানের সম্পর্ক যখন পারস্পরিক ভালোবাসার পরিবর্তে স্বার্থ ও দায়িত্বের ভারসাম্যে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন সেটি ভেঙে পড়তে বাধ্য। অবসরজীবনে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় স্বীকৃতি ও মানসিক আশ্রয়ের। কিন্তু সন্তানরা প্রায়ই মনে করে, অর্থনৈতিক সহায়তা দিলেই কর্তব্য শেষ। অথচ বৃদ্ধ পিতা-মাতার চাওয়া এতটুকুই—একটু সময়, একটি ফোনকল, একটি খবর নেওয়া, একটু যত্ন।

তবে দোষ একতরফা নয়। অনেক পিতা-মাতাও অবসরের পর নিজেদের জীবনকে কেবল সন্তাননির্ভর করে তোলেন। জীবনের আনন্দ, আত্মসম্মান, ও অর্থ খোঁজেন কেবল পুত্র-কন্যার আচরণে। অথচ অবসর মানেই শেষ নয়, এ সময় হতে পারে নতুন অভিজ্ঞতা, নতুন সম্পর্ক, নতুন সমাজসেবার। যারা নিজেদের সময়কে আত্মোন্নয়ন, বই, ভ্রমণ বা সেবার মধ্যে ব্যয় করেন, তারা একাকীত্বে ভোগেন না।

আজকের প্রজন্মেরও বোঝা দরকার পিতামাতা কোনো দায় নয়, তাঁরা জীবনের মূল ভিত্তি। তাঁদের অভিজ্ঞতা, পরিশ্রম, ত্যাগ ও ভালোবাসার প্রতিদান অর্থ দিয়ে মাপা যায় না। আবার পিতামাতারও উচিত, সন্তানদের জীবনে নিজেদের উপস্থিতি ‘নিয়ন্ত্রণ’ হিসেবে নয়, বরং ‘স্নেহের উপস্থিতি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। সম্পর্কের সৌন্দর্য তখনই টিকে থাকে, যখন তাতে থাকে পারস্পরিক সম্মান, বোঝাপড়া ও নিঃস্বার্থ মমতা।

বার্ধক্যের নিঃসঙ্গতা কোনো অপরিহার্য নিয়তি নয়—এটি সম্পর্কের বিকৃতি থেকে জন্ম নেওয়া এক মানসিক অবস্থা। দায়িত্ব যদি ভালোবাসায় রূপান্তরিত হয়, আর ভালোবাসা যদি প্রত্যাশাহীন থাকে, তবে অবসরও পরিণত হতে পারে এক প্রশান্ত জীবনের পথে।

শেষ বিকেলের কোমল আলোটি জানালার কাচে এসে মৃদুভাবে থেমে থাকে। ঘরে ছায়া-আলোয় মিশে তৈরি হয় এক নিস্তব্ধ প্রশান্তি। বৃদ্ধ দম্পতি বারান্দার চেয়ারে পাশাপাশি বসে আছেন, কারও মুখে কোনো কথা নেই, তবু তাদের চোখে ভেসে ওঠে বোঝাপড়ার এক নীরব ভাষা। এক মুহূর্তের জন্য তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসেন, যেন অতীতের অসংখ্য স্মৃতি সেই হাসিতে ফিরে আসে। হয়তো তারা ভাবেন, জীবনের সব হিসাব-নিকাশ, সব অভিমান, সব না-পাওয়া শেষ পর্যন্ত ভালোবাসার গভীরতায় গলে যায় নিঃশব্দে। মানুষ যতদিন ভালোবাসাকে দায়িত্বের থেকে বড় করে বুঝতে পারবে, ততদিন সম্পর্ক টিকে থাকবে তার আসল সৌন্দর্যে। আর যেদিন সত্যিই সবাই এই সত্য উপলব্ধি করবে, সেদিন অবসর আর নিঃসঙ্গতার প্রতীক থাকবে না, বরং তা হয়ে উঠবে জীবনের এক নতুন সূচনা, এক শান্ত ও পরিণত নবজাগরণ।

লেখক: কৃষিবিদ, কলামিষ্ট ও চেয়ারম্যান, ডিআরপি ফাউন্ডেশন। 

ড.রাধেশ্যাম সরকার

০১ নভেম্বর, ২০২৫,  3:14 PM

news image

দুপুরের শেষ আলোটি জানালার গায়ে এসে থেমেছে। এক অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ দম্পতি চুপচাপ বসে আছেন বারান্দার চেয়ারে। একসময় সংসারের কোলাহলে মুখর ছিল এই ঘর সন্তানের পড়াশোনা, পরীক্ষার উৎকণ্ঠা, ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা, আর সীমাহীন স্বপ্নের ভিড়। আজ ঘর নিঃশব্দ। চারপাশে ছড়িয়ে আছে অবসর, একাকীত্ব, আর অপ্রাপ্তির দীর্ঘ ছায়া। অবসরপ্রাপ্ত বাবা-মায়ের সবচেয়ে বড় ভয় এখন কেবল একটাই তা হলো সন্তানের সঙ্গে সম্পর্কের শৈথিল্য, এবং সেই সূত্রে বার্ধক্যের নিঃসঙ্গতা ও বিচ্ছিন্নতা। আধুনিক সময়ে এই ভয় কেবল পারিবারিক সংকট নয়, বরং একটি সামাজিক বাস্তবতাও বটে।

মানুষের জীবনে সবচেয়ে প্রিয় ও অবিচ্ছেদ্য সত্তা হলো তার সন্তান। সন্তানকে ঘিরেই পিতা-মাতার পৃথিবী গড়ে ওঠে। তাদের আশা, প্রয়াস, ভালোবাসা, স্বপ্ন আর সংগ্রামের সমস্ত রঙ সেই সন্তানকেন্দ্রিক। সন্তানের হাসিই তাদের দিনের আলো, সন্তানের দুঃখেই তারা অস্থির হয়। নিজের জীবনের ব্যর্থতা ও সীমাবদ্ধতাকে তারা ভুলে যায় যখন সন্তানের সাফল্যের মুখে একটুখানি তৃপ্তির ছায়া দেখতে পায়। সমাজে সন্তান যেন তার পিতা-মাতার স্বপ্নের পরিণতি, তাদের জীবনের সবচেয়ে সার্থক প্রকাশ। প্রতিটি মা-বাবা চায় তাদের সন্তান হোক নিজের চেয়েও যোগ্য, নিজের চেয়ে উচ্চতর, যে পূর্ণ করবে তাদের অসম্পূর্ণ ইচ্ছা ও অপূর্ণ সাধ। সেই আকাঙ্ক্ষার টানে তারা জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে পরিশ্রম করে, নিঃস্বার্থভাবে বিলিয়ে দেয় শ্রম, অর্থ, সময় আর স্নেহের প্রতিটি কণা। কিন্তু যে জীবনটি তারা এত যত্নে, এত ত্যাগে গড়ে তোলে, একদিন সেই সন্তানই নিজের জীবনের ব্যস্ততা, দায়িত্বের জটিলতা, কিংবা সম্পর্কের অগ্রাধিকারের পরিবর্তনের কারণে ধীরে ধীরে দূরে সরে যায়। নিঃশব্দে, অজান্তেই, যেন এক অদৃশ্য দূরত্ব জন্ম নেয় তাদের আপন সম্পর্কের মাঝে।

অবসরের পর পিতামাতা যখন জীবনের গতি থেমে যেতে থাকে, তখন তাদের সবচেয়ে প্রয়োজন হয় সম্পর্কের উষ্ণতা, কিছু সময়, কিছু কথা। কিন্তু তখন সন্তানরা থাকে কর্মব্যস্ত জীবনের কেন্দ্রে। পিতামাতার কাছে এই সময়ে যে প্রত্যাশা থাকে সেটি ভালোবাসার চেয়ে প্রায়ই দায়িত্বের রূপ নেয়।সমাজে প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী পুত্রের কাছেই থাকে পিতামাতার বার্ধক্যের ভরসা। কন্যা বিবাহের পর ‘অন্যের ঘরে’ চলে যায়। এই ধারণা থেকেই পুত্রের উপর দায়িত্বের ভার আরোপ করা হয়। অথচ এই ‘দায়িত্ব’ শব্দটিই অনেক সময় সম্পর্ককে ভারী ও যান্ত্রিক করে তোলে। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, যেসব সম্পর্ক দায়িত্ববোধের বাঁধনে গড়ে ওঠে, সেখানে স্নেহ ও মমতার প্রবাহ কমে যায়; সম্পর্ক হয়ে পড়ে কর্তব্যনির্ভর, উষ্ণতাহীন।

অনেক অবসরপ্রাপ্ত পিতা-মাতা অজান্তেই সন্তানের কাছে এক ধরনের জীবন্ত দাসত্বের প্রত্যাশা করেন। তারা চান, পুত্র যেন প্রতিটি প্রয়োজনে পাশে থাকে, প্রতিটি সংকটে দায়িত্ব নেয়, এবং তাদের জীবনযাপনেও অর্থনৈতিক সহায়তা দেয়। অথচ ভালোবাসা কখনোই হিসাবের বন্ধনে টেকে না। যে সম্পর্ক থেকে একতরফা অনুগত্যের দাবি করা হয়, সেটি ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ে। পুত্ররা অনেক সময় এ ধরনের অঘোষিত দাবির চাপেই মানসিক দূরত্ব তৈরি করে। বিপরীতে, পিতামাতা কন্যার কাছে কোনো প্রত্যাশা রাখেন না। সেই কারণেই কন্যার সামান্য স্নেহ-দর্শনও তাদের অপরিসীম আনন্দ দেয়।

সমাজে প্রায়শই শোনা যায়, “ছেলের বিয়ে হলে ছেলে বউয়ের হয়ে যায়, কিন্তু মেয়ে বিয়ে করলেও কখনো পর হয়ে যায় না।” এই কথাটির গভীরে আছে মানসিক পার্থক্যের এক সূক্ষ্ম সত্য। কন্যার প্রতি পিতামাতার ভালোবাসা নিঃস্বার্থ; তারা মেয়েকে কিছু দিলেও প্রত্যাবর্তনের আশা করে না। কন্যার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যই তাদের আনন্দের উৎস। কিন্তু পুত্রের ক্ষেত্রে ভালোবাসার সঙ্গে জুড়ে যায় প্রত্যাশা, দায়িত্ব, এমনকি আর্থিক হিসাব। ছেলের পড়াশোনা, চাকরি বা ব্যবসায় যে ব্যয় করা হয়েছে, তা অনেকের কাছে একপ্রকার বিনিয়োগের রূপ নেয়। বার্ধক্যে এসে তারা প্রায়ই বলেন, “তোর পিছনে এত খরচ করেছি, বিনিময়ে কী পেলাম?” কিন্তু এই প্রশ্নে সম্পর্কের মাধুর্য ক্ষয় হতে থাকে।  মেয়ের বিয়েতে পিতামাতা যত অর্থ ব্যয় করেন, ততটা কখনোই হিসাব করে দেখেন না। কিন্তু ছেলেকে পড়াশোনার জন্য অল্প কিছু সহায়তা দিলেও সেটির হিসাব মনে রাখেন। এমনকি মেয়ের জামাইকে যতটা সম্মান ও ভালোবাসা দেওয়া হয়, পুত্রবধূ প্রায়ই সেই মর্যাদা পায় না। একথা অস্বীকার করা যায় না যে, আমাদের সমাজে পুত্রবধূর প্রতি আচরণে এখনো সন্দেহ, তুলনা, এবং ঈর্ষার ছায়া রয়ে গেছে। শাশুড়ি অনেক সময় পুত্রবধূর সুখকে নিজের অতীত জীবনের সঙ্গে তুলনা করেন, “আমি পারিনি, তুই পারছিস কেন?” এই অজান্ত প্রতিযোগিতা পুত্রের মানসিক অবস্থাকেও জটিল করে তোলে।

এমন বাস্তবতায় পিতা-মাতা প্রায়ই অনুভব করেন, কন্যা সংসারে থেকেও তাঁদের কাছাকাছি, আর পুত্র এক ছাদের নিচে থেকেও দূরে। পুত্রের প্রতি যে শতভাগ প্রত্যাশা রাখা হয়, সে যদি তার ৭০ শতাংশও পূরণ করে, তবুও অবশিষ্ট ৩০ শতাংশের অভাবটাই চোখে পড়ে। অন্যদিকে, কন্যা যদি সামান্য কিছু খোঁজখবর নেয়, তাতেই মনে হয় সে অনেক কিছু করছে। এই দ্বৈত মানদণ্ডই সম্পর্ককে ভারসাম্যহীন করে তোলে।

একটি সমাজে পিতামাতা ও সন্তানের সম্পর্ক যখন পারস্পরিক ভালোবাসার পরিবর্তে স্বার্থ ও দায়িত্বের ভারসাম্যে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন সেটি ভেঙে পড়তে বাধ্য। অবসরজীবনে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় স্বীকৃতি ও মানসিক আশ্রয়ের। কিন্তু সন্তানরা প্রায়ই মনে করে, অর্থনৈতিক সহায়তা দিলেই কর্তব্য শেষ। অথচ বৃদ্ধ পিতা-মাতার চাওয়া এতটুকুই—একটু সময়, একটি ফোনকল, একটি খবর নেওয়া, একটু যত্ন।

তবে দোষ একতরফা নয়। অনেক পিতা-মাতাও অবসরের পর নিজেদের জীবনকে কেবল সন্তাননির্ভর করে তোলেন। জীবনের আনন্দ, আত্মসম্মান, ও অর্থ খোঁজেন কেবল পুত্র-কন্যার আচরণে। অথচ অবসর মানেই শেষ নয়, এ সময় হতে পারে নতুন অভিজ্ঞতা, নতুন সম্পর্ক, নতুন সমাজসেবার। যারা নিজেদের সময়কে আত্মোন্নয়ন, বই, ভ্রমণ বা সেবার মধ্যে ব্যয় করেন, তারা একাকীত্বে ভোগেন না।

আজকের প্রজন্মেরও বোঝা দরকার পিতামাতা কোনো দায় নয়, তাঁরা জীবনের মূল ভিত্তি। তাঁদের অভিজ্ঞতা, পরিশ্রম, ত্যাগ ও ভালোবাসার প্রতিদান অর্থ দিয়ে মাপা যায় না। আবার পিতামাতারও উচিত, সন্তানদের জীবনে নিজেদের উপস্থিতি ‘নিয়ন্ত্রণ’ হিসেবে নয়, বরং ‘স্নেহের উপস্থিতি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। সম্পর্কের সৌন্দর্য তখনই টিকে থাকে, যখন তাতে থাকে পারস্পরিক সম্মান, বোঝাপড়া ও নিঃস্বার্থ মমতা।

বার্ধক্যের নিঃসঙ্গতা কোনো অপরিহার্য নিয়তি নয়—এটি সম্পর্কের বিকৃতি থেকে জন্ম নেওয়া এক মানসিক অবস্থা। দায়িত্ব যদি ভালোবাসায় রূপান্তরিত হয়, আর ভালোবাসা যদি প্রত্যাশাহীন থাকে, তবে অবসরও পরিণত হতে পারে এক প্রশান্ত জীবনের পথে।

শেষ বিকেলের কোমল আলোটি জানালার কাচে এসে মৃদুভাবে থেমে থাকে। ঘরে ছায়া-আলোয় মিশে তৈরি হয় এক নিস্তব্ধ প্রশান্তি। বৃদ্ধ দম্পতি বারান্দার চেয়ারে পাশাপাশি বসে আছেন, কারও মুখে কোনো কথা নেই, তবু তাদের চোখে ভেসে ওঠে বোঝাপড়ার এক নীরব ভাষা। এক মুহূর্তের জন্য তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসেন, যেন অতীতের অসংখ্য স্মৃতি সেই হাসিতে ফিরে আসে। হয়তো তারা ভাবেন, জীবনের সব হিসাব-নিকাশ, সব অভিমান, সব না-পাওয়া শেষ পর্যন্ত ভালোবাসার গভীরতায় গলে যায় নিঃশব্দে। মানুষ যতদিন ভালোবাসাকে দায়িত্বের থেকে বড় করে বুঝতে পারবে, ততদিন সম্পর্ক টিকে থাকবে তার আসল সৌন্দর্যে। আর যেদিন সত্যিই সবাই এই সত্য উপলব্ধি করবে, সেদিন অবসর আর নিঃসঙ্গতার প্রতীক থাকবে না, বরং তা হয়ে উঠবে জীবনের এক নতুন সূচনা, এক শান্ত ও পরিণত নবজাগরণ।

লেখক: কৃষিবিদ, কলামিষ্ট ও চেয়ারম্যান, ডিআরপি ফাউন্ডেশন।