ড.রাধেশ্যাম সরকার
১৩ আগস্ট, ২০২৫, 7:00 PM
মানুষের হাত দুটো যেন সৃষ্টিকর্তার দেওয়া সমান দু’টি ডানা একটি দিয়ে আমরা দৈনন্দিন কাজ চালাই, যেমন আমরা লিখি, রান্না করি, দরজা খুলি, বাজারের ব্যাগ বহন করি যে কাজগুলো প্রতিদিন আমাদের জীবনকে চালায়। অন্য হাতটি যেন একটু ভিন্ন উদ্দেশ্যে কাজ করে; তা শুধু সাহায্যকারী হিসেবেই কাজ করে। একটিতে আছে স্থিতি ও অভ্যাস, আর অন্যটিতে আছে সৃজন ও সম্ভাবনা। এভাবে আমাদের দুই হাত মিলেই জীবনের ভারসাম্য রক্ষা করি। কিন্তু প্রকৃতির অদ্ভুত খেলায় একদল মানুষ জন্ম নেয় যাদের ডানার ভরসা বাঁ হাতে। পৃথিবীর প্রতিটি ভোরে তারা জাগে ভিন্ন ছন্দে, লেখে ভিন্ন বর্ণমালা, আঁকে জীবনের ছবিকে অন্য কোণ থেকে। ছোটবেলায় স্কুলে কলম ধরা শেখানোর সময় থেকে, খেলা ঘরের দৌড়ে বা রান্না ঘরের ছুরির কাজে তাদের হাতে জড়িয়ে থাকে এক অদ্ভুত দৃষ্টি, যা কখনও অবাক করে, কখনও বাঁধে কৌতূহলে। তবুও, এই বিশেষ মানুষদের যাত্রাপথে থাকে কিছু অস্বস্তি, কিছু অসুবিধা, আর অসংখ্য গল্প যেখানে তারা প্রমাণ করে, বাঁহাত মানেই পিছিয়ে থাকা নয়; বরং অনন্য হয়ে ওঠা।
১৩ আগস্ট বিশ্বজুড়ে পালিত হয় এক বিশেষ দিন, “আন্তর্জাতিক বাঁহাতি দিবস”। ১৯৭৬ সালে প্রথমবারের মতো এই দিনটি পালিত হয় বাঁহাতি মানুষের স্বীকৃতি ও সম্মান জানাতে। মূল উদ্দেশ্য ছিল, যারা দৈনন্দিন জীবনে বাঁহাতকে প্রাধান্য দেন, তাদের অধিকার রক্ষা করা, জীবনের নানা ক্ষেত্রে তারা যে অসুবিধার মুখোমুখি হন তা দূর করা, এবং সমাজে প্রচলিত ভুল ধারণাগুলো ভাঙা। কারণ, বাঁহাতিরা প্রায়শই এমন এক পৃথিবীতে পথচলে যেখানে অধিকাংশ জিনিস বানানো হয়েছে ডানহাতিদের জন্য যেমন-স্কুলের বেঞ্চ, কাঁচি, কম্পিউটার মাউস, এমনকি বাদ্যযন্ত্রও। অথচ ইতিহাস সাক্ষী, বাঁহাতি মানুষদের মধ্যে জন্মেছে অসংখ্য মেধাবী শিল্পী, বিজ্ঞানী, খেলোয়াড় ও নেতা, যারা নিজেদের স্বকীয়তার মাধ্যমে বিশ্বকে দিয়েছে নতুন দিশা। আন্তর্জাতিক বাঁহাতি দিবস আজও আমাদের মনে করিয়ে দেয়, এই পৃথিবীতে বাঁহাতিরা শুধু ভিন্ন নন, বরং তাদের সৃষ্টিশীলতা, অভিযোজন ক্ষমতা এবং ব্যতিক্রমী দৃষ্টিভঙ্গি অনেক ক্ষেত্রেই অসাধারণতার প্রতীক।
গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৯ থেকে ১২ শতাংশ মানুষ বাঁহাতি, যা সংখ্যায় তুলনামূলকভাবে কম হলেও বৈচিত্র্যের এক বিশেষ নিদর্শন। ইউরোপের ১৭টি দেশের লেখার অভ্যাস পর্যবেক্ষণ করে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২.৫% থেকে ১২.৮% মানুষ বাঁ হাতে লেখেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, পুরুষদের মধ্যে বাঁহাতির হার নারীদের তুলনায় বেশি, যা বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে একটি আকর্ষণীয় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। জিনতত্ত্ববিদরা প্রায় ৪০টি ভিন্ন জিনকে এই প্রবণতার পেছনের সম্ভাব্য কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যেগুলো মস্তিষ্কের গঠন ও স্নায়ুর সংযোগের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। আরও বিস্ময়কর তথ্য হলো, জন্মের সময় প্রায় ৭৫% শিশুই বাঁহাতি হওয়ার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মায়। কিন্তু বড় হতে হতে, সামাজিক রীতি, পরিবারিক প্রত্যাশা, বিদ্যালয়ের নিয়ম এবং বিভিন্ন পরিবেশগত চাপে অনেকেই ধীরে ধীরে ডানহাতি হয়ে যায়।ফলে, প্রকৃত বাঁহাতি মানুষের সংখ্যা আমাদের চোখে যতটুকু ধরা পড়ে, বাস্তবে তার চেয়েও অনেক বেশি হতে পারত। প্লজ জেনেটিকস জার্নালের এক গবেষণা বলছে গর্ভাবস্থায় শিশুর অবস্থান, জন্মের সময়কাল, এমনকি প্রিম্যাচিউর জন্মও বাঁহাতি হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ায়। মা-বাবা দুজন বাঁহাতি হলেও সন্তান বাঁহাতি হওয়ার সম্ভাবনা মাত্র ২৬%। আর শুধুমানুষই নয় অস্ট্রেলিয়ান ক্যাঙ্গারুর মতো কিছু প্রাণীও বাঁহাতি প্রবণতা প্রদর্শন করে।
মানব মস্তিষ্কের ডান অংশ যুক্তি, কল্পনা, সৃজনশীলতা ও স্থানিক চিন্তার জন্য দায়ী এবং বাঁহাতিরা সাধারণত এ অংশ বেশি ব্যবহার করেন। ফলত তারা সমস্যা সমাধানে অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি, সৃজনশীল উদ্ভাবনী ক্ষমতা এবং মাল্টিটাস্কিংয়ে দক্ষতা দেখান। ক্রিস এমসি ম্যামস এর গবেষণায় বলা হয়েছে, বাঁহাতিদের কৃতিত্ব, আইকিউ এবং সংগীত ও গণিতের দক্ষতা অনেক সময় ডান হাতিদের চেয়ে বেশি। বিশ্ব ইতিহাসের বহু প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব বাঁহাতি ছিলেন যেমন-
আলবার্ট আইনস্টাইন, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, মেরি কুরি, বারাক ওবামা, বিল ক্লিনটন, জর্জএইচ. ডব্লিউ. বুশ, মোৎসার্ট, লেডি গাগা, জুলিয়া রবার্টস, হুপি গোল্ডবার্গ, চার্লি চাপলিন, ম্যারাডোনা, ব্রায়ান লারা, ওয়াসিম আকরাম, যুবরাজ সিং, সাকিব আল হাসান, লিওনেল মেসি যাদের নাম ইতিহাসের পাতায় অক্ষয় হয়ে আছে।
ক্রীড়াক্ষেত্রে বাঁহাতিরা প্রায়ই প্রতিপক্ষকে অপ্রস্তুত করে দেন। ক্রিকেট, টেনিস, টেবিল টেনিস, ব্যাডমিন্টন বা বেসবলের মতো খেলায়তাদের ব্যাট, বল বা শটের দিক বদলে দেয় খেলার হিসাব। প্রতিযোগিতার ময়দানে এই ‘বাঁহাতের জাদু’ এক অনন্য অস্ত্র। ২০০৬ সালে ইউএসএ এর লাফায়েত কলেজ ও জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, বাঁহাতিরা গড়ে ১০-১৫% বেশি আয় করেন। যুক্তরাষ্ট্রের বহু সফল উদ্যোক্তা, শিল্পী ও রাজনীতিবিদ বাঁহাতি যা প্রমাণ করে যে হাতের ভিন্নতা তাদের সাফল্যের পথে বাধা নয়, বরং বিশেষ দক্ষতার পরিচায়ক।
স্বাস্থ্যগত দিক থেকেও কিছু বিশেষত্ব আছে।গবেষণায় দেখা গেছে, বাঁহাতিরা স্ট্রোক থেকে তুলনামূলক দ্রুত সেরে ওঠেন। তারা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে পরিণতি বিচার করেন, ফলে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতা বেশি। তবে নেতিবাচক দিকও আছে যেমন মাইগ্রেন, অনিদ্রা ও এলার্জির প্রবণতা কিছুটা বেশি দেখা যায়। দৈনন্দিন জীবনে বাঁহাতিদের অসুবিধাও আরো আছে। বাজারে পাওয়া অধিকাংশ সরঞ্জাম যেমন দরজার লক, কাঁচি, কলম, কম্পিউটার মাউস বা রান্না ঘরের সরঞ্জাম সবই ডান হাতিদের উপযোগী করে তৈরি। ফলে বাঁহাতিরা অনেক সময় ছোট ছোট কাজে অস্বস্তি বোধ করেন, এমনকি দুর্ঘটনার শিকার হন। এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, প্রতিবছর বিশ্বে দুই হাজারের বেশি বাঁহাতি সরঞ্জামের অসুবিধাজনিত কারণে দুর্ঘটনায় পড়েন।
আন্তর্জাতিক বাঁহাতি দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় প্রকৃতির বৈচিত্র্যই মানবসমাজের সৌন্দর্য। বাঁহাতিরা আলাদা বলেই বিশেষ, কিন্তু সেই আলাদা হওয়াকে বৈষম্যের কারণ না বানিয়ে তাদের সৃজনশীলতা ও প্রতিভাকে কাজে লাগানোই এই দিবসের বার্তা। সমাজ, শিক্ষা ব্যবস্থা ও প্রযুক্তিকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করা প্রয়োজন, যাতে বাঁহাতিরা প্রতিদিনের জীবনে সমান স্বাচ্ছন্দ্য ও মর্যাদাপান। যেমন একটি নদীর বাঁক তাকে দেয় নিজস্ব সৌন্দর্য, তেমনি মানুষের হাতের ভিন্নতা তাকে দেয় স্বকীয় পরিচয়। ইতিহাস প্রমাণ করেছে, বাঁহাতিরা শুধু কাগজে কলমে নয়, মঞ্চে, মাঠে, গবেষণাগারে এবং শিল্পকর্মে ছড়িয়েছেন সাফল্যের আলো। তাই বাঁহাতি হওয়া কোনো দৈবক্রম নয় এ এক অনন্য সত্তা, যা আমাদের শেখায় ভিন্নতাকে ভালোবাসতে, বৈচিত্র্যকে সম্মান করতে। হয়তো সেদিনই পৃথিবী সত্যিকার অর্থে সুন্দর হয়ে উঠবে, যেদিন বাঁহাতি-ডানহাতি বিভাজন মুছে গিয়ে আমরা সবাই কেবল ‘মানুষ’ হয়ে উঠব সৃজনশীল, সম্ভাবনাময় এবং সমান মর্যাদা সম্পন্ন।
লেখক: অবসরপ্রপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ও চেয়ারম্যান, ডিআরপি ফাউন্ডেশন।
ড.রাধেশ্যাম সরকার
১৩ আগস্ট, ২০২৫, 7:00 PM
মানুষের হাত দুটো যেন সৃষ্টিকর্তার দেওয়া সমান দু’টি ডানা একটি দিয়ে আমরা দৈনন্দিন কাজ চালাই, যেমন আমরা লিখি, রান্না করি, দরজা খুলি, বাজারের ব্যাগ বহন করি যে কাজগুলো প্রতিদিন আমাদের জীবনকে চালায়। অন্য হাতটি যেন একটু ভিন্ন উদ্দেশ্যে কাজ করে; তা শুধু সাহায্যকারী হিসেবেই কাজ করে। একটিতে আছে স্থিতি ও অভ্যাস, আর অন্যটিতে আছে সৃজন ও সম্ভাবনা। এভাবে আমাদের দুই হাত মিলেই জীবনের ভারসাম্য রক্ষা করি। কিন্তু প্রকৃতির অদ্ভুত খেলায় একদল মানুষ জন্ম নেয় যাদের ডানার ভরসা বাঁ হাতে। পৃথিবীর প্রতিটি ভোরে তারা জাগে ভিন্ন ছন্দে, লেখে ভিন্ন বর্ণমালা, আঁকে জীবনের ছবিকে অন্য কোণ থেকে। ছোটবেলায় স্কুলে কলম ধরা শেখানোর সময় থেকে, খেলা ঘরের দৌড়ে বা রান্না ঘরের ছুরির কাজে তাদের হাতে জড়িয়ে থাকে এক অদ্ভুত দৃষ্টি, যা কখনও অবাক করে, কখনও বাঁধে কৌতূহলে। তবুও, এই বিশেষ মানুষদের যাত্রাপথে থাকে কিছু অস্বস্তি, কিছু অসুবিধা, আর অসংখ্য গল্প যেখানে তারা প্রমাণ করে, বাঁহাত মানেই পিছিয়ে থাকা নয়; বরং অনন্য হয়ে ওঠা।
১৩ আগস্ট বিশ্বজুড়ে পালিত হয় এক বিশেষ দিন, “আন্তর্জাতিক বাঁহাতি দিবস”। ১৯৭৬ সালে প্রথমবারের মতো এই দিনটি পালিত হয় বাঁহাতি মানুষের স্বীকৃতি ও সম্মান জানাতে। মূল উদ্দেশ্য ছিল, যারা দৈনন্দিন জীবনে বাঁহাতকে প্রাধান্য দেন, তাদের অধিকার রক্ষা করা, জীবনের নানা ক্ষেত্রে তারা যে অসুবিধার মুখোমুখি হন তা দূর করা, এবং সমাজে প্রচলিত ভুল ধারণাগুলো ভাঙা। কারণ, বাঁহাতিরা প্রায়শই এমন এক পৃথিবীতে পথচলে যেখানে অধিকাংশ জিনিস বানানো হয়েছে ডানহাতিদের জন্য যেমন-স্কুলের বেঞ্চ, কাঁচি, কম্পিউটার মাউস, এমনকি বাদ্যযন্ত্রও। অথচ ইতিহাস সাক্ষী, বাঁহাতি মানুষদের মধ্যে জন্মেছে অসংখ্য মেধাবী শিল্পী, বিজ্ঞানী, খেলোয়াড় ও নেতা, যারা নিজেদের স্বকীয়তার মাধ্যমে বিশ্বকে দিয়েছে নতুন দিশা। আন্তর্জাতিক বাঁহাতি দিবস আজও আমাদের মনে করিয়ে দেয়, এই পৃথিবীতে বাঁহাতিরা শুধু ভিন্ন নন, বরং তাদের সৃষ্টিশীলতা, অভিযোজন ক্ষমতা এবং ব্যতিক্রমী দৃষ্টিভঙ্গি অনেক ক্ষেত্রেই অসাধারণতার প্রতীক।
গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৯ থেকে ১২ শতাংশ মানুষ বাঁহাতি, যা সংখ্যায় তুলনামূলকভাবে কম হলেও বৈচিত্র্যের এক বিশেষ নিদর্শন। ইউরোপের ১৭টি দেশের লেখার অভ্যাস পর্যবেক্ষণ করে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২.৫% থেকে ১২.৮% মানুষ বাঁ হাতে লেখেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, পুরুষদের মধ্যে বাঁহাতির হার নারীদের তুলনায় বেশি, যা বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে একটি আকর্ষণীয় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। জিনতত্ত্ববিদরা প্রায় ৪০টি ভিন্ন জিনকে এই প্রবণতার পেছনের সম্ভাব্য কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যেগুলো মস্তিষ্কের গঠন ও স্নায়ুর সংযোগের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। আরও বিস্ময়কর তথ্য হলো, জন্মের সময় প্রায় ৭৫% শিশুই বাঁহাতি হওয়ার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মায়। কিন্তু বড় হতে হতে, সামাজিক রীতি, পরিবারিক প্রত্যাশা, বিদ্যালয়ের নিয়ম এবং বিভিন্ন পরিবেশগত চাপে অনেকেই ধীরে ধীরে ডানহাতি হয়ে যায়।ফলে, প্রকৃত বাঁহাতি মানুষের সংখ্যা আমাদের চোখে যতটুকু ধরা পড়ে, বাস্তবে তার চেয়েও অনেক বেশি হতে পারত। প্লজ জেনেটিকস জার্নালের এক গবেষণা বলছে গর্ভাবস্থায় শিশুর অবস্থান, জন্মের সময়কাল, এমনকি প্রিম্যাচিউর জন্মও বাঁহাতি হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ায়। মা-বাবা দুজন বাঁহাতি হলেও সন্তান বাঁহাতি হওয়ার সম্ভাবনা মাত্র ২৬%। আর শুধুমানুষই নয় অস্ট্রেলিয়ান ক্যাঙ্গারুর মতো কিছু প্রাণীও বাঁহাতি প্রবণতা প্রদর্শন করে।
মানব মস্তিষ্কের ডান অংশ যুক্তি, কল্পনা, সৃজনশীলতা ও স্থানিক চিন্তার জন্য দায়ী এবং বাঁহাতিরা সাধারণত এ অংশ বেশি ব্যবহার করেন। ফলত তারা সমস্যা সমাধানে অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি, সৃজনশীল উদ্ভাবনী ক্ষমতা এবং মাল্টিটাস্কিংয়ে দক্ষতা দেখান। ক্রিস এমসি ম্যামস এর গবেষণায় বলা হয়েছে, বাঁহাতিদের কৃতিত্ব, আইকিউ এবং সংগীত ও গণিতের দক্ষতা অনেক সময় ডান হাতিদের চেয়ে বেশি। বিশ্ব ইতিহাসের বহু প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব বাঁহাতি ছিলেন যেমন-
আলবার্ট আইনস্টাইন, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, মেরি কুরি, বারাক ওবামা, বিল ক্লিনটন, জর্জএইচ. ডব্লিউ. বুশ, মোৎসার্ট, লেডি গাগা, জুলিয়া রবার্টস, হুপি গোল্ডবার্গ, চার্লি চাপলিন, ম্যারাডোনা, ব্রায়ান লারা, ওয়াসিম আকরাম, যুবরাজ সিং, সাকিব আল হাসান, লিওনেল মেসি যাদের নাম ইতিহাসের পাতায় অক্ষয় হয়ে আছে।
ক্রীড়াক্ষেত্রে বাঁহাতিরা প্রায়ই প্রতিপক্ষকে অপ্রস্তুত করে দেন। ক্রিকেট, টেনিস, টেবিল টেনিস, ব্যাডমিন্টন বা বেসবলের মতো খেলায়তাদের ব্যাট, বল বা শটের দিক বদলে দেয় খেলার হিসাব। প্রতিযোগিতার ময়দানে এই ‘বাঁহাতের জাদু’ এক অনন্য অস্ত্র। ২০০৬ সালে ইউএসএ এর লাফায়েত কলেজ ও জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, বাঁহাতিরা গড়ে ১০-১৫% বেশি আয় করেন। যুক্তরাষ্ট্রের বহু সফল উদ্যোক্তা, শিল্পী ও রাজনীতিবিদ বাঁহাতি যা প্রমাণ করে যে হাতের ভিন্নতা তাদের সাফল্যের পথে বাধা নয়, বরং বিশেষ দক্ষতার পরিচায়ক।
স্বাস্থ্যগত দিক থেকেও কিছু বিশেষত্ব আছে।গবেষণায় দেখা গেছে, বাঁহাতিরা স্ট্রোক থেকে তুলনামূলক দ্রুত সেরে ওঠেন। তারা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে পরিণতি বিচার করেন, ফলে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতা বেশি। তবে নেতিবাচক দিকও আছে যেমন মাইগ্রেন, অনিদ্রা ও এলার্জির প্রবণতা কিছুটা বেশি দেখা যায়। দৈনন্দিন জীবনে বাঁহাতিদের অসুবিধাও আরো আছে। বাজারে পাওয়া অধিকাংশ সরঞ্জাম যেমন দরজার লক, কাঁচি, কলম, কম্পিউটার মাউস বা রান্না ঘরের সরঞ্জাম সবই ডান হাতিদের উপযোগী করে তৈরি। ফলে বাঁহাতিরা অনেক সময় ছোট ছোট কাজে অস্বস্তি বোধ করেন, এমনকি দুর্ঘটনার শিকার হন। এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, প্রতিবছর বিশ্বে দুই হাজারের বেশি বাঁহাতি সরঞ্জামের অসুবিধাজনিত কারণে দুর্ঘটনায় পড়েন।
আন্তর্জাতিক বাঁহাতি দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় প্রকৃতির বৈচিত্র্যই মানবসমাজের সৌন্দর্য। বাঁহাতিরা আলাদা বলেই বিশেষ, কিন্তু সেই আলাদা হওয়াকে বৈষম্যের কারণ না বানিয়ে তাদের সৃজনশীলতা ও প্রতিভাকে কাজে লাগানোই এই দিবসের বার্তা। সমাজ, শিক্ষা ব্যবস্থা ও প্রযুক্তিকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করা প্রয়োজন, যাতে বাঁহাতিরা প্রতিদিনের জীবনে সমান স্বাচ্ছন্দ্য ও মর্যাদাপান। যেমন একটি নদীর বাঁক তাকে দেয় নিজস্ব সৌন্দর্য, তেমনি মানুষের হাতের ভিন্নতা তাকে দেয় স্বকীয় পরিচয়। ইতিহাস প্রমাণ করেছে, বাঁহাতিরা শুধু কাগজে কলমে নয়, মঞ্চে, মাঠে, গবেষণাগারে এবং শিল্পকর্মে ছড়িয়েছেন সাফল্যের আলো। তাই বাঁহাতি হওয়া কোনো দৈবক্রম নয় এ এক অনন্য সত্তা, যা আমাদের শেখায় ভিন্নতাকে ভালোবাসতে, বৈচিত্র্যকে সম্মান করতে। হয়তো সেদিনই পৃথিবী সত্যিকার অর্থে সুন্দর হয়ে উঠবে, যেদিন বাঁহাতি-ডানহাতি বিভাজন মুছে গিয়ে আমরা সবাই কেবল ‘মানুষ’ হয়ে উঠব সৃজনশীল, সম্ভাবনাময় এবং সমান মর্যাদা সম্পন্ন।
লেখক: অবসরপ্রপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ও চেয়ারম্যান, ডিআরপি ফাউন্ডেশন।