CKEditor 5 Sample
ঢাকা ২১ নভেম্বর, ২০২৫

বার্ধক্যের প্রতি শ্রদ্ধা: তরুণ প্রজন্মের নৈতিক চেতনা

#
news image

বার্ধক্য জীবনের অবিচ্ছেদ্য ও অনিবার্য এক ঋতু, যা অবশেষে সবার দ্বারেই নীরবে এসে দাঁড়ায়; আর এর রঙ-সুর নির্ধারিত হয় তরুণ সমাজের মনোভাব ও আচরণে। একসময় যারা ছিলেন আমাদের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ও ত্যাগের প্রতীক, আজ সেই প্রবীণরা অনাদর, অবহেলা ও নীরব নির্যাতনের শিকার যার সূচনা হয় অনেক সময় নিজের পরিবারের আঙিনায়। বয়সের ভারে কর্মক্ষমতা হারিয়ে আর্থিক অবদান রাখতে না পারলেও, তাদের হৃদয়ে রয়ে যায় অমূল্য জীবনের গল্প ও ত্যাগের স্মৃতি। অথচ পরিবার ও সমাজ এই ধনভাণ্ডারকে যত্নের বদলে অবহেলায় দূরে সরিয়ে দিলে প্রবীণ জীবনের শেষ অধ্যায় হয়ে ওঠে নিঃসঙ্গ প্রান্তর, যেখানে বেদনার দীর্ঘ ছায়া আর নিরাশার নীরব কান্নাই থাকে সঙ্গী।
জাতিসংঘ ও বাংলাদেশ সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী, ৬০ বছর এবং তদূর্ধ্ব বয়সীদের প্রবীণ হিসেবে গণ্য করা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২’-এর প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি ৪৬ লাখ, যার মধ্যে ৬০ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৫৩ লাখ ২৬ হাজার ৭১৯ জন, অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ৯.২৮ শতাংশ। ২০১১ সালের তুলনায় এই হার প্রায় ২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে প্রবীণ সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখে  এবং পরবর্তী কয়েক দশকে দ্রুত বৃদ্ধির ফলে ২০৫০ সালেএই সংখ্যা ৪ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। 
বার্ধক্যে প্রবীণরা শারীরিক অসুস্থতা, চলাফেরার সীমাবদ্ধতা ও আর্থিক সংকটে ভুগে অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। চিকিৎসা ও ওষুধের অভাব, মানসিক অবহেলা ও নিঃসঙ্গতা তাদের জীবনে গভীর বেদনা আনে। অথচ তারাই আমাদের ইতিহাসের ধারক, বাহক ও ভবিষ্যতের ভিত্তি; তাই প্রবীণজীবন স্বস্তিময় ও শান্তিপূর্ণ করা তরুণ সমাজের মানবিক দায়িত্ব। 
প্রবীণদের প্রতি নবীনদের প্রথম দায়িত্ব হলো তাদের গভীর সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শন। তাদের সঙ্গে কথা বলার সময় ভদ্র, কোমল ও শ্রদ্ধাশীল আচরণ বজায় রাখতে হবে। ধমকের সুর এড়িয়ে সৌজন্যমূলক ভাষা ব্যবহার করলে তারা শুধু স্বস্তি পান না, বরং অনুভব করেন তাদের  অভিজ্ঞতা ও অবস্থান এখনো মূল্যবান। 
পরিবারের প্রতিটি সদস্যের প্রবীণদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন জরুরি।তারা কেবল বয়সে বৃদ্ধ নন, বরং অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞার অফুরন্ত ভান্ডার। তরুণদের উচিত অনুভূতির গভীর থেকে প্রবীণদের প্রতি নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ লালন করা, যাতে তারা শান্তি ও আনন্দের সঙ্গী হয়ে থাকেন। প্রবীণরা যেন নিঃসঙ্গতা ও অবহেলায় হতাশ না হন, সে বিষয়ে তরুণদের সচেতন থাকা আবশ্যক।
যারা অর্থনৈতিক ও মানসিকভাবে দুর্বল,তাদের প্রতি আরও যত্নশীল হতে হবে। বয়স্করা শিশুদের মতো আবেগপ্রবণ; অল্পতেই ব্যথা পান, অল্পতেই খুশি হন। তাই তাদের প্রতিসদয়, সহনশীল ও সম্মানজনক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। কথার ভঙ্গি এমন হওয়া উচিত যা মন ব্যথিত না করে বরং স্নেহ ও শান্তির বার্তা পৌঁছায়। প্রবীণদের জীবনের গল্প শোনুন, তাদের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া জরুরি। তারা চান কেউ তাদের কথা শুনুক যেমন মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা, ঐতিহাসিক স্মৃতি কিংবা জীবনের নানা বাস্তবতা। এসব শোনার মাধ্যমে তরুণদের মনে স্নেহ ও শ্রদ্ধা জাগ্রত হয়।
প্রবীণরা কেবল বিনোদনের জন্য মুখিয়ে থাকেন না, বরং তরুণদের হাসি-কৌতুক, আড্ডা ও স্নেহময় কথোপকথনে অংশ নিতে চান। তাদের সঙ্গে সময় কাটানো, উৎসব ও আলোচনায় আমন্ত্রণ জানানো তাদের প্রাণের চাহিদা। এক ফোঁটা হাসি তাদের জন্য হাজার টাকার ঔষধের সমান। তাই তরুণরা যতটা সম্ভব তাদের সঙ্গে সময় কাটাবেন ও আনন্দে অংশ নেবেন। 
প্রবীণরা অনেক সময় শিশুসুলভ আচরণ করেন, যা কখনো বিরক্তিকর মনে হতে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, শৈশবের উদারতা ও আবেগ প্রবীণ জীবনের অংশ।তাই রূঢ়তা বা ধমকের সুর এড়িয়ে সদাচরণ ও সম্মান প্রদর্শন করা উচিত। মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতে হবে যেন আমরাও প্রবীণদের প্রতি সেই ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে পারি।
পরিবারের তরুণদের উচিত নিয়মিত প্রবীণদের খোঁজখবর নেওয়া। অফিসে যাওয়ার আগে বা ফিরে এসে তাদের সঙ্গে কিছু সময় কাটানো, খাওয়া-দাওয়া ও ওষুধ নেওয়া, স্বাস্থ্যের খোঁজ রাখা প্রয়োজন। প্রবীণরা প্রায়শই একা থেকে অসহায় বোধ করেন, তাই তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা নৈতিক দায়িত্ব। 
তাদের থাকার পরিবেশ সুষ্ঠু ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করতে হবে আলো-বাতাসপূর্ণ ঘর, পিচ্ছিল মুক্ত মেঝে, সংযুক্ত বাথরুমে সাপোর্টিং বার, পরিষ্কার বিছানা ও বালিশ ইত্যাদি নিশ্চিত করতে হবে। 
স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন বজায় রাখতে নিয়মিত চিকিৎসা পরিদর্শন, সঠিক ওষুধ ব্যবস্থাপনা ও সময়মতো ওষুধ সেবন জরুরি। ওষুধ ভুলভাবে বা অতিরিক্ত খাওয়া বিপজ্জনক, তাই সকালের,  দুপুরের ও রাতের ওষুধ আলাদা পাত্রে রাখা উচিত। ডাক্তার প্রদত্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসায় অবহেলা করা যাবে না।
সামাজিক, পারিবারিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে প্রবীণদের আমন্ত্রণ জানাতে হবে এবং সম্মানজনক স্থানে বসার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তারা অবহেলিত না বোধ করেন। 
তাদের উপস্থিতিতে পরিবারের ঐক্য দৃঢ় হয়, সমাজে মানবিক মূল্যবোধের প্রসার ঘটে। ছুটির দিনে বা অবসরে বাড়ি ফিরে প্রবীণ মা-বাবা, দাদা-দাদি, নানা-নানি অথবা প্রতিবেশী প্রবীণদের সঙ্গে সময় কাটানো, ছোট ছোট যত্ন যেমন নখ কাটা, চুল আঁচড়া বা গোসল করানো তাদের মন খুশি করে এবং ভালোবাসা প্রকাশ পায়। 
পরিবারের সদস্যদের তদারকি করতে হবে যেন প্রবীণরা সরকারি ভাতা ও সুবিধা পেতে কোনো বাধার সম্মুখীন না হন।
প্রবীণদের সর্বদা সালাম, নমস্কার বা প্রণাম জানানো উচিত। এর মাধ্যমে আমরা স্বীকার করি যে, আমাদের সমাজব্যবস্থা তাদের অভিজ্ঞতা ও প্রচেষ্টার ওপর দাঁড়িয়ে আছে।রাতে তাদের জন্য মশারি টানিয়ে দেওয়া, সকালে খুলে দেওয়া, একা থাকলে এটেন্ডেন্ট রাখা, নিয়মিত গোসল করানো, পরিষ্কার জামাকাপড় পরানো, সহজ পাচ্য ও পুষ্টিকর খাবার দেওয়া জরুরি। খাবারে তাদের পছন্দকে প্রাধান্য দিতে হবে এবং ক্ষুধা লাগার আগেই খাবার সরবরাহ করতে হবে।
প্রবীণরা সমাজের ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক।তাদের প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা ও মেধা সমাজের উন্নয়নে কাজে লাগাতে হবে, যেমন গ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তদারকি, স্কুল পরিচ্ছন্নতা, বিচার সালিশ বা উন্নয়ন প্রকল্পে অংশগ্রহণ।
তরুণদের উচিত তাদের স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচলের সুযোগ দেওয়া; বাস, ট্রেন বা লঞ্চে আসন ছেড়ে দেওয়া, রাস্তা পারাপারে সহায়তা, রোদ-বৃষ্টিতে সুরক্ষা, ব্যাংক ও হাসপাতালে ‘প্রায়োরিটি সার্ভিস’ নিশ্চিত করা। 
প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে প্রবীণদের সহায়তা করা, আধুনিক ডিভাইস ব্যবহারে প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং সচেতন করা প্রয়োজন।একই সঙ্গে তরুণদেরও প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা উচিত, কারণ প্রযুক্তির আসক্তি ও মাদকাসক্তির ক্ষতি একই রকম ভয়াবহ। 
প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও সম্মান কেবল তাদের অধিকার রক্ষার বিষয় নয়; এটি আমাদের অন্তরের গভীর মানবিক দায়বদ্ধতা, যা সমাজের প্রাণস্রোতকে সচল রাখে এবং সভ্যতার ভিত্তিকে দৃঢ় করে। তাদের যত্ন নেওয়া মানে শুধু দায়িত্ব পালন নয় এটি পরিবার ও সমাজে রক্তসঞ্চার ঘটানো, যা আমাদের মানবিকতার অস্তিত্বকে অটুট রাখে। তরুণ প্রজন্ম যদি আন্তরিক নৈতিকতা ও মূল্যবোধ নিয়ে প্রবীণ সেবায় নিজেকে নিবেদন করে, তবে তাদের জীবন হয়ে উঠবে শান্তি ও স্নেহে ভরা এক বাগান যেখানে প্রতিটি দিন সিক্ত থাকবে মমতার সুবাসে, আর প্রতিটি রাত থাকবে স্নেহের কোমল ছায়ায় আচ্ছন্ন। কারণ প্রবীণরা শুধু সমাজের ভিত্তি গড়ে তোলেন নি, তারা সময়ের সাক্ষী হয়ে প্রজ্ঞার দীপ জ্বালিয়েছেন, যা আমাদের জীবনের পথপ্রদীপ। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাই সমাজকল্যাণ ও উন্নতির চিরন্তন স্তম্ভ; এর অভাবে সভ্যতা পথভ্রষ্ট হয়ে ধ্বংসের মুখোমুখি হবে। এই দায়িত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়েই আমরা প্রকৃত মানবিকতার পরিচয় গড়তে পারি, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে যাবে আদর্শ ও প্রেমের বাতিঘর হয়ে। আমাদের প্রত্যাশা প্রতিটি তরুণের হৃদয়ে প্রবীণদের জন্য অগাধ শ্রদ্ধা ও স্নেহ জেগে উঠুক, যেন প্রবীণ জীবন রূপ নেয় শান্তি ও মর্যাদার। এই অমলিন মানবিক বন্ধনই হবে সমাজের শাশ্বত সম্পদ, যার স্রোতে বহমান থাকবে কালজয়ী ঐতিহ্য ও অনন্ত ভালোবাসা।


সিনিয়র কৃষিবিদ, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ও চেয়ারম্যান, ডিআরপি ফাউন্ডেশন।

ড. রাধেশ্যাম সরকার

১২ আগস্ট, ২০২৫,  3:43 PM

news image

বার্ধক্য জীবনের অবিচ্ছেদ্য ও অনিবার্য এক ঋতু, যা অবশেষে সবার দ্বারেই নীরবে এসে দাঁড়ায়; আর এর রঙ-সুর নির্ধারিত হয় তরুণ সমাজের মনোভাব ও আচরণে। একসময় যারা ছিলেন আমাদের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ও ত্যাগের প্রতীক, আজ সেই প্রবীণরা অনাদর, অবহেলা ও নীরব নির্যাতনের শিকার যার সূচনা হয় অনেক সময় নিজের পরিবারের আঙিনায়। বয়সের ভারে কর্মক্ষমতা হারিয়ে আর্থিক অবদান রাখতে না পারলেও, তাদের হৃদয়ে রয়ে যায় অমূল্য জীবনের গল্প ও ত্যাগের স্মৃতি। অথচ পরিবার ও সমাজ এই ধনভাণ্ডারকে যত্নের বদলে অবহেলায় দূরে সরিয়ে দিলে প্রবীণ জীবনের শেষ অধ্যায় হয়ে ওঠে নিঃসঙ্গ প্রান্তর, যেখানে বেদনার দীর্ঘ ছায়া আর নিরাশার নীরব কান্নাই থাকে সঙ্গী।
জাতিসংঘ ও বাংলাদেশ সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী, ৬০ বছর এবং তদূর্ধ্ব বয়সীদের প্রবীণ হিসেবে গণ্য করা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২’-এর প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি ৪৬ লাখ, যার মধ্যে ৬০ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৫৩ লাখ ২৬ হাজার ৭১৯ জন, অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ৯.২৮ শতাংশ। ২০১১ সালের তুলনায় এই হার প্রায় ২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে প্রবীণ সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখে  এবং পরবর্তী কয়েক দশকে দ্রুত বৃদ্ধির ফলে ২০৫০ সালেএই সংখ্যা ৪ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। 
বার্ধক্যে প্রবীণরা শারীরিক অসুস্থতা, চলাফেরার সীমাবদ্ধতা ও আর্থিক সংকটে ভুগে অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। চিকিৎসা ও ওষুধের অভাব, মানসিক অবহেলা ও নিঃসঙ্গতা তাদের জীবনে গভীর বেদনা আনে। অথচ তারাই আমাদের ইতিহাসের ধারক, বাহক ও ভবিষ্যতের ভিত্তি; তাই প্রবীণজীবন স্বস্তিময় ও শান্তিপূর্ণ করা তরুণ সমাজের মানবিক দায়িত্ব। 
প্রবীণদের প্রতি নবীনদের প্রথম দায়িত্ব হলো তাদের গভীর সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শন। তাদের সঙ্গে কথা বলার সময় ভদ্র, কোমল ও শ্রদ্ধাশীল আচরণ বজায় রাখতে হবে। ধমকের সুর এড়িয়ে সৌজন্যমূলক ভাষা ব্যবহার করলে তারা শুধু স্বস্তি পান না, বরং অনুভব করেন তাদের  অভিজ্ঞতা ও অবস্থান এখনো মূল্যবান। 
পরিবারের প্রতিটি সদস্যের প্রবীণদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন জরুরি।তারা কেবল বয়সে বৃদ্ধ নন, বরং অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞার অফুরন্ত ভান্ডার। তরুণদের উচিত অনুভূতির গভীর থেকে প্রবীণদের প্রতি নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ লালন করা, যাতে তারা শান্তি ও আনন্দের সঙ্গী হয়ে থাকেন। প্রবীণরা যেন নিঃসঙ্গতা ও অবহেলায় হতাশ না হন, সে বিষয়ে তরুণদের সচেতন থাকা আবশ্যক।
যারা অর্থনৈতিক ও মানসিকভাবে দুর্বল,তাদের প্রতি আরও যত্নশীল হতে হবে। বয়স্করা শিশুদের মতো আবেগপ্রবণ; অল্পতেই ব্যথা পান, অল্পতেই খুশি হন। তাই তাদের প্রতিসদয়, সহনশীল ও সম্মানজনক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। কথার ভঙ্গি এমন হওয়া উচিত যা মন ব্যথিত না করে বরং স্নেহ ও শান্তির বার্তা পৌঁছায়। প্রবীণদের জীবনের গল্প শোনুন, তাদের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া জরুরি। তারা চান কেউ তাদের কথা শুনুক যেমন মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা, ঐতিহাসিক স্মৃতি কিংবা জীবনের নানা বাস্তবতা। এসব শোনার মাধ্যমে তরুণদের মনে স্নেহ ও শ্রদ্ধা জাগ্রত হয়।
প্রবীণরা কেবল বিনোদনের জন্য মুখিয়ে থাকেন না, বরং তরুণদের হাসি-কৌতুক, আড্ডা ও স্নেহময় কথোপকথনে অংশ নিতে চান। তাদের সঙ্গে সময় কাটানো, উৎসব ও আলোচনায় আমন্ত্রণ জানানো তাদের প্রাণের চাহিদা। এক ফোঁটা হাসি তাদের জন্য হাজার টাকার ঔষধের সমান। তাই তরুণরা যতটা সম্ভব তাদের সঙ্গে সময় কাটাবেন ও আনন্দে অংশ নেবেন। 
প্রবীণরা অনেক সময় শিশুসুলভ আচরণ করেন, যা কখনো বিরক্তিকর মনে হতে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, শৈশবের উদারতা ও আবেগ প্রবীণ জীবনের অংশ।তাই রূঢ়তা বা ধমকের সুর এড়িয়ে সদাচরণ ও সম্মান প্রদর্শন করা উচিত। মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতে হবে যেন আমরাও প্রবীণদের প্রতি সেই ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে পারি।
পরিবারের তরুণদের উচিত নিয়মিত প্রবীণদের খোঁজখবর নেওয়া। অফিসে যাওয়ার আগে বা ফিরে এসে তাদের সঙ্গে কিছু সময় কাটানো, খাওয়া-দাওয়া ও ওষুধ নেওয়া, স্বাস্থ্যের খোঁজ রাখা প্রয়োজন। প্রবীণরা প্রায়শই একা থেকে অসহায় বোধ করেন, তাই তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা নৈতিক দায়িত্ব। 
তাদের থাকার পরিবেশ সুষ্ঠু ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করতে হবে আলো-বাতাসপূর্ণ ঘর, পিচ্ছিল মুক্ত মেঝে, সংযুক্ত বাথরুমে সাপোর্টিং বার, পরিষ্কার বিছানা ও বালিশ ইত্যাদি নিশ্চিত করতে হবে। 
স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন বজায় রাখতে নিয়মিত চিকিৎসা পরিদর্শন, সঠিক ওষুধ ব্যবস্থাপনা ও সময়মতো ওষুধ সেবন জরুরি। ওষুধ ভুলভাবে বা অতিরিক্ত খাওয়া বিপজ্জনক, তাই সকালের,  দুপুরের ও রাতের ওষুধ আলাদা পাত্রে রাখা উচিত। ডাক্তার প্রদত্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসায় অবহেলা করা যাবে না।
সামাজিক, পারিবারিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে প্রবীণদের আমন্ত্রণ জানাতে হবে এবং সম্মানজনক স্থানে বসার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তারা অবহেলিত না বোধ করেন। 
তাদের উপস্থিতিতে পরিবারের ঐক্য দৃঢ় হয়, সমাজে মানবিক মূল্যবোধের প্রসার ঘটে। ছুটির দিনে বা অবসরে বাড়ি ফিরে প্রবীণ মা-বাবা, দাদা-দাদি, নানা-নানি অথবা প্রতিবেশী প্রবীণদের সঙ্গে সময় কাটানো, ছোট ছোট যত্ন যেমন নখ কাটা, চুল আঁচড়া বা গোসল করানো তাদের মন খুশি করে এবং ভালোবাসা প্রকাশ পায়। 
পরিবারের সদস্যদের তদারকি করতে হবে যেন প্রবীণরা সরকারি ভাতা ও সুবিধা পেতে কোনো বাধার সম্মুখীন না হন।
প্রবীণদের সর্বদা সালাম, নমস্কার বা প্রণাম জানানো উচিত। এর মাধ্যমে আমরা স্বীকার করি যে, আমাদের সমাজব্যবস্থা তাদের অভিজ্ঞতা ও প্রচেষ্টার ওপর দাঁড়িয়ে আছে।রাতে তাদের জন্য মশারি টানিয়ে দেওয়া, সকালে খুলে দেওয়া, একা থাকলে এটেন্ডেন্ট রাখা, নিয়মিত গোসল করানো, পরিষ্কার জামাকাপড় পরানো, সহজ পাচ্য ও পুষ্টিকর খাবার দেওয়া জরুরি। খাবারে তাদের পছন্দকে প্রাধান্য দিতে হবে এবং ক্ষুধা লাগার আগেই খাবার সরবরাহ করতে হবে।
প্রবীণরা সমাজের ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক।তাদের প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা ও মেধা সমাজের উন্নয়নে কাজে লাগাতে হবে, যেমন গ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তদারকি, স্কুল পরিচ্ছন্নতা, বিচার সালিশ বা উন্নয়ন প্রকল্পে অংশগ্রহণ।
তরুণদের উচিত তাদের স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচলের সুযোগ দেওয়া; বাস, ট্রেন বা লঞ্চে আসন ছেড়ে দেওয়া, রাস্তা পারাপারে সহায়তা, রোদ-বৃষ্টিতে সুরক্ষা, ব্যাংক ও হাসপাতালে ‘প্রায়োরিটি সার্ভিস’ নিশ্চিত করা। 
প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে প্রবীণদের সহায়তা করা, আধুনিক ডিভাইস ব্যবহারে প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং সচেতন করা প্রয়োজন।একই সঙ্গে তরুণদেরও প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা উচিত, কারণ প্রযুক্তির আসক্তি ও মাদকাসক্তির ক্ষতি একই রকম ভয়াবহ। 
প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও সম্মান কেবল তাদের অধিকার রক্ষার বিষয় নয়; এটি আমাদের অন্তরের গভীর মানবিক দায়বদ্ধতা, যা সমাজের প্রাণস্রোতকে সচল রাখে এবং সভ্যতার ভিত্তিকে দৃঢ় করে। তাদের যত্ন নেওয়া মানে শুধু দায়িত্ব পালন নয় এটি পরিবার ও সমাজে রক্তসঞ্চার ঘটানো, যা আমাদের মানবিকতার অস্তিত্বকে অটুট রাখে। তরুণ প্রজন্ম যদি আন্তরিক নৈতিকতা ও মূল্যবোধ নিয়ে প্রবীণ সেবায় নিজেকে নিবেদন করে, তবে তাদের জীবন হয়ে উঠবে শান্তি ও স্নেহে ভরা এক বাগান যেখানে প্রতিটি দিন সিক্ত থাকবে মমতার সুবাসে, আর প্রতিটি রাত থাকবে স্নেহের কোমল ছায়ায় আচ্ছন্ন। কারণ প্রবীণরা শুধু সমাজের ভিত্তি গড়ে তোলেন নি, তারা সময়ের সাক্ষী হয়ে প্রজ্ঞার দীপ জ্বালিয়েছেন, যা আমাদের জীবনের পথপ্রদীপ। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাই সমাজকল্যাণ ও উন্নতির চিরন্তন স্তম্ভ; এর অভাবে সভ্যতা পথভ্রষ্ট হয়ে ধ্বংসের মুখোমুখি হবে। এই দায়িত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়েই আমরা প্রকৃত মানবিকতার পরিচয় গড়তে পারি, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে যাবে আদর্শ ও প্রেমের বাতিঘর হয়ে। আমাদের প্রত্যাশা প্রতিটি তরুণের হৃদয়ে প্রবীণদের জন্য অগাধ শ্রদ্ধা ও স্নেহ জেগে উঠুক, যেন প্রবীণ জীবন রূপ নেয় শান্তি ও মর্যাদার। এই অমলিন মানবিক বন্ধনই হবে সমাজের শাশ্বত সম্পদ, যার স্রোতে বহমান থাকবে কালজয়ী ঐতিহ্য ও অনন্ত ভালোবাসা।


সিনিয়র কৃষিবিদ, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ও চেয়ারম্যান, ডিআরপি ফাউন্ডেশন।