CKEditor 5 Sample
ঢাকা ২১ নভেম্বর, ২০২৫

পরিবেশ রক্ষায় পাট প্লাষ্টিকের  বিকল্প

#
news image

জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ দূষণ বর্তমানে মানব সভ্যতার অস্তিত্বের জন্য দুটি বড় সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সংকটের অন্যতম প্রধান কারণ হলো প্লাস্টিক ও পলিথিনের লাগামহীন ব্যবহার। প্লাস্টিকের নানা রকম দ্রব্য, অণু ও কণিকা পরিবেশে সহজে পচে না এবং দীর্ঘসময় ধরে মাটি, পানি, বায়ু, জীববৈচিত্র্য ও মানবস্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। মানবসৃষ্ট এই দূষণ আজ পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি ইকোসিস্টেমকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
বিশ্বজুড়ে প্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহতা দিন দিন বাড়ছে। গবেষণা বলছে, প্রতিদিন প্রায় ৮০লাখ টুকরা প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে।এর ফলে বিশাল বিশাল প্লাস্টিকের প্যাচ তৈরি হয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে বড়টি প্রশান্ত মহাসাগরে, যার আয়তন প্রায় ১৬ লাখ বর্গ কিলোমিটার। শুধু সমুদ্রের তলদেশ নয়, পানির উপরের স্তরেরও প্রায় ৮৮ ভাগ এখন প্লাস্টিক দূষণে আক্রান্ত। এই প্লাস্টিক দূষণে প্রতিবছর প্রায় ১০ লাখ সামুদ্রিক পাখি এবং এক লাখেরও বেশি সামুদ্রিক প্রাণী, যেমন বিশাল তিমি মাছও, মৃত্যুর মুখে পতিত হচ্ছে।
প্লাস্টিক ব্যাগ বা পলিথিন পরিবেশ দূষণের সবচেয়ে বড় উৎসগুলোর অন্যতম। এই পণ্যগুলো তৈরি হয় পেট্রোলিয়াম থেকে নিষ্কাষিত সিনথেটিক পলিমার দ্বারা, যা জৈব বিয়োজনশীল নয় এবং শত শত বছর পর্যন্ত মাটি, পানি ও বাতাসে রয়ে যায়। বিশ্বে প্রতিদিন গড়ে ৫০ কোটিরও বেশি প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার করা হয় এবং বছরে এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১ ট্রিলিয়ন টনের কাছাকাছি। এই বিপুল পরিমাণ পলিথিন উৎপাদনে খনিজ তেলের ওপর চাপ বাড়ছে; শুধু ১ ট্রিলিয়ন পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন করতে পৃথিবীর মোট খনিজ তেলের প্রায় ৪ শতাংশ ব্যবহার হয়। এসব ব্যাগ ব্যবহারের পর অধিকাংশই বর্জ্য হিসেবে জমা হয়, যেগুলো পুনঃব্যবহার যোগ্য না হওয়ায় পুড়িয়ে ফেলার বা মাটিতে পুঁতে রাখার বিকল্প থাকে না। অথচ এই পোড়ানো প্রক্রিয়া পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।গবেষণা অনুযায়ী, এক টন প্লাস্টিক ব্যাগ পোড়ালে প্রায় ১,৩৪০ কেজি কার্বনডাই-অক্সাইড বাতাসে নিঃসৃত হয়। এই গ্যাস সরাসরি পৃথিবীর উষ্ণায়নের জন্য দায়ী এবং বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রায় ১০-১৩ শতাংশ এই একক উৎস থেকেই আসে। শুধু কার্বনডাই-অক্সাইড নয়, পোড়ানোর ফলে আরও অনেক বিষাক্ত গ্যাস যেমন ডাইঅক্সিন ও ফিউরান নির্গত হয়, যা মানব স্বাস্থ্য ও জীব বৈচিত্র্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। তাই পলিথিনের লাগামহীন ব্যবহার রোধ করা ও এর পরিবেশ বান্ধব বিকল্প খুঁজে বের করাই এখন সময়ের দাবি।
এই পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিকের বিকল্প খোঁজার প্রবণতা দ্রুত বাড়ছে। উন্নত ও উন্নয়নশীল উভয় দেশেই পরিবেশবান্ধব উপকরণের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। এই সন্ধানে সবচেয়ে কার্যকর ও বাস্তবসম্মত সমাধান হিসেবে উঠে এসেছে প্রাকৃতিক তন্তু বিশেষ করে পাট। পাট শুধু একটি কৃষিপণ্য নয়, এটি টেকসই, পুনর্ব্যবহারযোগ্য ও পরিবেশ রক্ষাকারী বিকল্প, যা প্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে প্রকৃতিকে রক্ষা করতে পারে। ব্যাগ, বস্তা, মোড়ক, খেলনা, বাসকেট, এমনকি বস্ত্র ও আসবাবপত্র তৈরি হচ্ছে পাট দিয়ে। পাট সহজে পচনশীল হওয়ায় পরিবেশে কোনো বিষাক্ত পদার্থ জমে না। বরং এটি পচে গিয়ে মাটির উর্বরতা বাড়ায় এবং এতে থাকা পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম ও নাইট্রোজেন উপকারে আসে। পাট চাষে খুব কম সার ও কীটনাশক লাগে, যা কৃষকের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য নিরাপদ। গবেষণায় দেখা গেছে, পাট গাছ প্রতি হেক্টরে প্রায় ১৫ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে এবং ১১ টনসঅক্সিজেন ছাড়ে।

বিশ্বের শীর্ষ পাট উৎপাদক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। দেশের জলবায়ু ও উর্বর মাটি পাট চাষে সহায়ক।বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত পণ্যের চাহিদা বিশ্বের প্রায় ৬০টির বেশি দেশে রয়েছে। ভারত, চীন, তুরস্ক, মিশর, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশ বাংলাদেশ থেকে পাট আমদানি করে। পরিবেশ সচেতনতার কারণে কৃত্রিম তন্তুর ব্যবহার কমে গিয়ে পাটের চাহিদা বেড়েছে। পাট দিয়ে তৈরি ব্যাগ, মোড়ক, হস্তশিল্প ও ফ্যাশন পণ্যের কদর বেড়েছে উন্নত বিশ্বে। টেকসই ও পরিবেশবান্ধব হওয়ায় পাটকে এখন ‘গোল্ডেন ফাইবার অব হোপ’ বলা হয়।কম খরচে বেশি লাভের কারণে কৃষকেরাও পাটচাষে আগ্রহী হচ্ছে। বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান শক্ত হচ্ছে এবং এটি অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।ভবিষ্যতে সঠিক পরিকল্পনা ও প্রযুক্তির মাধ্যমে পাটকে ঘিরে একটি নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে পারে।
পাটের পরিবেশগত উপকারিতা অনেক। পাটফসল মাটির ১০–১২ ইঞ্চি গভীরে শিকড় প্রবেশ করায় ‘প্লাউপ্যান’ ভেঙে দিয়ে নিচের স্তরের খনিজ উপাদান মাটির উপরের স্তরে এনে মাটিকে উর্বর করে। প্রতি হেক্টরে পাট চাষের সময় ৫–৬ টন পাট পাতা পড়ে যা নাইট্রোজেন, ক্যারোটিন, সোডিয়াম, পটাশিয়াম ও ক্যালসিয়ামের মতো উপাদানে ভরপুর এবং জৈবসার হিসেবে কাজ করে। পাট কাটার পর গোড়াসহ শিকড় জমিতে পচে গিয়ে মাটির গুণগত মান বৃদ্ধি করে, ফলে পরবর্তী যেকোনো ফসলের ফলনও বাড়ে।
তুলনামূলকভাবে, এক টন পাটজাত ব্যাগ বা বস্তা পোড়ালে বাতাসে মাত্র ১৫০ কেজি কার্বনডাই-অক্সাইড নির্গত হয়, যেখানে সমপরিমাণ প্লাস্টিক পোড়ালে নির্গমন হয় ১,৩৪০ কেজি।তাই পরিবেশগত দৃষ্টিকোণ থেকে পাট একটি নিরাপদ এবং টেকসই উপাদান। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা খাদ্যশস্য ও চিনি মোড়কজাত করার ক্ষেত্রে পাটজাত মোড়ক ব্যবহারের সুপারিশ করেছে।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশে পাট দিয়ে পরিবেশবান্ধব প্লাস্টিক তৈরির চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে।কানাডিয়ান ফেল কোম্পানি বাংলাদেশে তাদের কান্ট্রি প্রতিনিধি নিয়োগ করেছে, যারা প্লাস্টিকের সঙ্গে ৩০% পাট মিশিয়ে পরিবেশবান্ধব প্লাস্টিক তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছে। এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে বৈশ্বিক পরিবেশ সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশ একটি মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে।
সরকারও পাট ও পাটজাত পণ্যের প্রসারে সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছে। ২০২৩ সালে পাটজাত পণ্যকে ‘বর্ষপণ্য’ ঘোষণা করা হয় এবং পাটকে কৃষিপণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন, ২০১০, বিধিমালা ২০১৩, পাট আইনশ ২০১৭, জাতীয় পাটনীতি ২০১৮ প্রণয়ন করে সরকারের পক্ষ থেকে পাট খাতকে সুরক্ষিত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টারস(জেডিপিসি)-এর উদ্যোগে দেশি উদ্যোক্তারা দৃষ্টিনন্দন ও শৈল্পিক গুণসম্পন্ন বহু পাটজাতপণ্য  তৈরি করছেন। সরকার এই পণ্যের রপ্তানিতে নগদ সহায়তাও প্রদান করছে।শীতপ্রধান দেশগুলোতে পাটের কাপড়ের চাহিদা বেড়েছে, আরব দেশগুলোতে পাটের কার্পেট ও হস্তশিল্প পণ্যের কদর বেড়েছে।আমেরিকা ও ইউরোপের বাজারে স্মার্ট ব্যাগ, জুট ডেনিম, পাটের টব, খেলনা, জুতা, স্যান্ডেল, বাসকেট ও এমনকি পাটের তৈরি কফিনও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। যুদ্ধে বা দুর্ভিক্ষে বিধ্বস্ত এলাকাগুলোতে ত্রাণসামগ্রী বিতরণের জন্য পাটের দড়ি ও বস্তা ব্যবহারের চাহিদাশব্যাপক। এছাড়া বাঁধ নির্মাণ, নদী ভাঙন রোধ, ভূমিক্ষয় ঠেকানো ও পাহাড় ধস প্রতিরোধে পাটের তৈরি জিও টেক্সটাইল অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখছে। ফলে পাট শুধু কৃষিপণ্য নয়, বরংএকটি টেকসই উন্নয়ন ও পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পাচ্ছে।
এই বাস্তবতায়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাহিদা মেটাতে পাটচাষ ও পাটজাত পণ্যের বহুমুখীকরণ অপরিহার্য। এজন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ, পণ্যের বৈচিত্র্য বাড়ানো, আন্তর্জাতিক বাজারে স্বদেশি পণ্যের কার্যকর ব্র্যান্ডিং এবং রপ্তানি ক্ষেত্রে আইনি প্রতিবন্ধকতা দূর করার লক্ষ্যে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী গড়তে প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে পাটের ব্যবহার বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। পাট শুধু একটি আঁশ নয়, এটি আমাদের পরিবেশের রক্ষাকবচ, একটি টেকসই পৃথিবীর আশার আলো।
লেখক: সিনিয়র কৃষিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা।

ড.রাধেশ্যাম সরকার

০৬ আগস্ট, ২০২৫,  6:22 PM

news image

জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ দূষণ বর্তমানে মানব সভ্যতার অস্তিত্বের জন্য দুটি বড় সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সংকটের অন্যতম প্রধান কারণ হলো প্লাস্টিক ও পলিথিনের লাগামহীন ব্যবহার। প্লাস্টিকের নানা রকম দ্রব্য, অণু ও কণিকা পরিবেশে সহজে পচে না এবং দীর্ঘসময় ধরে মাটি, পানি, বায়ু, জীববৈচিত্র্য ও মানবস্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। মানবসৃষ্ট এই দূষণ আজ পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি ইকোসিস্টেমকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
বিশ্বজুড়ে প্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহতা দিন দিন বাড়ছে। গবেষণা বলছে, প্রতিদিন প্রায় ৮০লাখ টুকরা প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে।এর ফলে বিশাল বিশাল প্লাস্টিকের প্যাচ তৈরি হয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে বড়টি প্রশান্ত মহাসাগরে, যার আয়তন প্রায় ১৬ লাখ বর্গ কিলোমিটার। শুধু সমুদ্রের তলদেশ নয়, পানির উপরের স্তরেরও প্রায় ৮৮ ভাগ এখন প্লাস্টিক দূষণে আক্রান্ত। এই প্লাস্টিক দূষণে প্রতিবছর প্রায় ১০ লাখ সামুদ্রিক পাখি এবং এক লাখেরও বেশি সামুদ্রিক প্রাণী, যেমন বিশাল তিমি মাছও, মৃত্যুর মুখে পতিত হচ্ছে।
প্লাস্টিক ব্যাগ বা পলিথিন পরিবেশ দূষণের সবচেয়ে বড় উৎসগুলোর অন্যতম। এই পণ্যগুলো তৈরি হয় পেট্রোলিয়াম থেকে নিষ্কাষিত সিনথেটিক পলিমার দ্বারা, যা জৈব বিয়োজনশীল নয় এবং শত শত বছর পর্যন্ত মাটি, পানি ও বাতাসে রয়ে যায়। বিশ্বে প্রতিদিন গড়ে ৫০ কোটিরও বেশি প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার করা হয় এবং বছরে এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১ ট্রিলিয়ন টনের কাছাকাছি। এই বিপুল পরিমাণ পলিথিন উৎপাদনে খনিজ তেলের ওপর চাপ বাড়ছে; শুধু ১ ট্রিলিয়ন পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন করতে পৃথিবীর মোট খনিজ তেলের প্রায় ৪ শতাংশ ব্যবহার হয়। এসব ব্যাগ ব্যবহারের পর অধিকাংশই বর্জ্য হিসেবে জমা হয়, যেগুলো পুনঃব্যবহার যোগ্য না হওয়ায় পুড়িয়ে ফেলার বা মাটিতে পুঁতে রাখার বিকল্প থাকে না। অথচ এই পোড়ানো প্রক্রিয়া পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।গবেষণা অনুযায়ী, এক টন প্লাস্টিক ব্যাগ পোড়ালে প্রায় ১,৩৪০ কেজি কার্বনডাই-অক্সাইড বাতাসে নিঃসৃত হয়। এই গ্যাস সরাসরি পৃথিবীর উষ্ণায়নের জন্য দায়ী এবং বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রায় ১০-১৩ শতাংশ এই একক উৎস থেকেই আসে। শুধু কার্বনডাই-অক্সাইড নয়, পোড়ানোর ফলে আরও অনেক বিষাক্ত গ্যাস যেমন ডাইঅক্সিন ও ফিউরান নির্গত হয়, যা মানব স্বাস্থ্য ও জীব বৈচিত্র্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। তাই পলিথিনের লাগামহীন ব্যবহার রোধ করা ও এর পরিবেশ বান্ধব বিকল্প খুঁজে বের করাই এখন সময়ের দাবি।
এই পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিকের বিকল্প খোঁজার প্রবণতা দ্রুত বাড়ছে। উন্নত ও উন্নয়নশীল উভয় দেশেই পরিবেশবান্ধব উপকরণের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। এই সন্ধানে সবচেয়ে কার্যকর ও বাস্তবসম্মত সমাধান হিসেবে উঠে এসেছে প্রাকৃতিক তন্তু বিশেষ করে পাট। পাট শুধু একটি কৃষিপণ্য নয়, এটি টেকসই, পুনর্ব্যবহারযোগ্য ও পরিবেশ রক্ষাকারী বিকল্প, যা প্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে প্রকৃতিকে রক্ষা করতে পারে। ব্যাগ, বস্তা, মোড়ক, খেলনা, বাসকেট, এমনকি বস্ত্র ও আসবাবপত্র তৈরি হচ্ছে পাট দিয়ে। পাট সহজে পচনশীল হওয়ায় পরিবেশে কোনো বিষাক্ত পদার্থ জমে না। বরং এটি পচে গিয়ে মাটির উর্বরতা বাড়ায় এবং এতে থাকা পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম ও নাইট্রোজেন উপকারে আসে। পাট চাষে খুব কম সার ও কীটনাশক লাগে, যা কৃষকের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য নিরাপদ। গবেষণায় দেখা গেছে, পাট গাছ প্রতি হেক্টরে প্রায় ১৫ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে এবং ১১ টনসঅক্সিজেন ছাড়ে।

বিশ্বের শীর্ষ পাট উৎপাদক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। দেশের জলবায়ু ও উর্বর মাটি পাট চাষে সহায়ক।বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত পণ্যের চাহিদা বিশ্বের প্রায় ৬০টির বেশি দেশে রয়েছে। ভারত, চীন, তুরস্ক, মিশর, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশ বাংলাদেশ থেকে পাট আমদানি করে। পরিবেশ সচেতনতার কারণে কৃত্রিম তন্তুর ব্যবহার কমে গিয়ে পাটের চাহিদা বেড়েছে। পাট দিয়ে তৈরি ব্যাগ, মোড়ক, হস্তশিল্প ও ফ্যাশন পণ্যের কদর বেড়েছে উন্নত বিশ্বে। টেকসই ও পরিবেশবান্ধব হওয়ায় পাটকে এখন ‘গোল্ডেন ফাইবার অব হোপ’ বলা হয়।কম খরচে বেশি লাভের কারণে কৃষকেরাও পাটচাষে আগ্রহী হচ্ছে। বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান শক্ত হচ্ছে এবং এটি অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।ভবিষ্যতে সঠিক পরিকল্পনা ও প্রযুক্তির মাধ্যমে পাটকে ঘিরে একটি নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে পারে।
পাটের পরিবেশগত উপকারিতা অনেক। পাটফসল মাটির ১০–১২ ইঞ্চি গভীরে শিকড় প্রবেশ করায় ‘প্লাউপ্যান’ ভেঙে দিয়ে নিচের স্তরের খনিজ উপাদান মাটির উপরের স্তরে এনে মাটিকে উর্বর করে। প্রতি হেক্টরে পাট চাষের সময় ৫–৬ টন পাট পাতা পড়ে যা নাইট্রোজেন, ক্যারোটিন, সোডিয়াম, পটাশিয়াম ও ক্যালসিয়ামের মতো উপাদানে ভরপুর এবং জৈবসার হিসেবে কাজ করে। পাট কাটার পর গোড়াসহ শিকড় জমিতে পচে গিয়ে মাটির গুণগত মান বৃদ্ধি করে, ফলে পরবর্তী যেকোনো ফসলের ফলনও বাড়ে।
তুলনামূলকভাবে, এক টন পাটজাত ব্যাগ বা বস্তা পোড়ালে বাতাসে মাত্র ১৫০ কেজি কার্বনডাই-অক্সাইড নির্গত হয়, যেখানে সমপরিমাণ প্লাস্টিক পোড়ালে নির্গমন হয় ১,৩৪০ কেজি।তাই পরিবেশগত দৃষ্টিকোণ থেকে পাট একটি নিরাপদ এবং টেকসই উপাদান। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা খাদ্যশস্য ও চিনি মোড়কজাত করার ক্ষেত্রে পাটজাত মোড়ক ব্যবহারের সুপারিশ করেছে।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশে পাট দিয়ে পরিবেশবান্ধব প্লাস্টিক তৈরির চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে।কানাডিয়ান ফেল কোম্পানি বাংলাদেশে তাদের কান্ট্রি প্রতিনিধি নিয়োগ করেছে, যারা প্লাস্টিকের সঙ্গে ৩০% পাট মিশিয়ে পরিবেশবান্ধব প্লাস্টিক তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছে। এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে বৈশ্বিক পরিবেশ সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশ একটি মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে।
সরকারও পাট ও পাটজাত পণ্যের প্রসারে সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছে। ২০২৩ সালে পাটজাত পণ্যকে ‘বর্ষপণ্য’ ঘোষণা করা হয় এবং পাটকে কৃষিপণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন, ২০১০, বিধিমালা ২০১৩, পাট আইনশ ২০১৭, জাতীয় পাটনীতি ২০১৮ প্রণয়ন করে সরকারের পক্ষ থেকে পাট খাতকে সুরক্ষিত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টারস(জেডিপিসি)-এর উদ্যোগে দেশি উদ্যোক্তারা দৃষ্টিনন্দন ও শৈল্পিক গুণসম্পন্ন বহু পাটজাতপণ্য  তৈরি করছেন। সরকার এই পণ্যের রপ্তানিতে নগদ সহায়তাও প্রদান করছে।শীতপ্রধান দেশগুলোতে পাটের কাপড়ের চাহিদা বেড়েছে, আরব দেশগুলোতে পাটের কার্পেট ও হস্তশিল্প পণ্যের কদর বেড়েছে।আমেরিকা ও ইউরোপের বাজারে স্মার্ট ব্যাগ, জুট ডেনিম, পাটের টব, খেলনা, জুতা, স্যান্ডেল, বাসকেট ও এমনকি পাটের তৈরি কফিনও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। যুদ্ধে বা দুর্ভিক্ষে বিধ্বস্ত এলাকাগুলোতে ত্রাণসামগ্রী বিতরণের জন্য পাটের দড়ি ও বস্তা ব্যবহারের চাহিদাশব্যাপক। এছাড়া বাঁধ নির্মাণ, নদী ভাঙন রোধ, ভূমিক্ষয় ঠেকানো ও পাহাড় ধস প্রতিরোধে পাটের তৈরি জিও টেক্সটাইল অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখছে। ফলে পাট শুধু কৃষিপণ্য নয়, বরংএকটি টেকসই উন্নয়ন ও পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পাচ্ছে।
এই বাস্তবতায়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাহিদা মেটাতে পাটচাষ ও পাটজাত পণ্যের বহুমুখীকরণ অপরিহার্য। এজন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ, পণ্যের বৈচিত্র্য বাড়ানো, আন্তর্জাতিক বাজারে স্বদেশি পণ্যের কার্যকর ব্র্যান্ডিং এবং রপ্তানি ক্ষেত্রে আইনি প্রতিবন্ধকতা দূর করার লক্ষ্যে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী গড়তে প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে পাটের ব্যবহার বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। পাট শুধু একটি আঁশ নয়, এটি আমাদের পরিবেশের রক্ষাকবচ, একটি টেকসই পৃথিবীর আশার আলো।
লেখক: সিনিয়র কৃষিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা।