ইউসুফ আলী বাচ্চু
২২ জুলাই, ২০২৫, 6:56 PM
দুর্ঘটনা ঘটার পরেই সমাধানের কথা আসে, কিন্তু কিছুদিন পরেই আমরা তা ভুলে যাই। সমস্যা থেকেই যায়, আর রাষ্ট্রও পুরনো ঘটনার কথা বেমালুম ভুলে যায়। রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা যেন দায়িত্বের শেষ, কিন্তু যার সন্তান, মা, বাবা, স্বজন হারায়, তারাই কেবল জানে তাদের বেদনা। আবার এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে কেউ কেউ ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টায় থাকে।
প্রতিবার বড় দুর্ঘটনার পর এই একই প্রশ্ন যেন আরও প্রবলভাবে প্রতিধ্বনিত হয়। গত ২১ জুলাই উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনে বিমানবাহিনীর এফ-৭ বিজেআই প্রশিক্ষণ বিমানের বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা এই প্রশ্নকে নতুন করে সামনে এনেছে।
মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি: রোদ ঝলমলে দিনে শোকের ছায়া
দিনটি রোদ ঝলমলে হলেও নেমে আসে শোকের ছায়া। ওইদিন দুপুর ১টা ৬ মিনিটে উড্ডয়ন করা যুদ্ধবিমানটি মাত্র ১২ মিনিটের মাথায় দুর্ঘটনায় পতিত হয়। সংবাদ মাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যাওয়া ছোট ছোট নিষ্পাপ ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির মর্মস্পর্শী চিত্র দেখা যায়।
ঘটনার পর সরকার পরদিন, অর্থাৎ ২২ জুলাই একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে। প্রধান উপদেষ্টা, তিন বাহিনীর প্রধান, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধানরা শোকবার্তা জানিয়েছেন। কিন্তু এই প্রতীকী আনুষ্ঠানিকতা কি আসল সমাধান? জনগণের চোখে এটা মনে হয় যেন দায়িত্ব এড়ানোর এক সহজ কৌশল। এই দুর্ঘটনা আমাদের দেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থার ভয়াবহ দুর্বলতা, আন্তরিকতার অভাব এবং শাসনব্যবস্থার অদক্ষতাকে আবারও নগ্নভাবে প্রকাশ করেছে।
বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় এখনও পর্যন্ত পাইলটসহ ৩১ জন মারা গেছেন। এছাড়া ১৬৫ জন আহত হয়েছেন। সোমবার (২১ জুলাই) দুপুরে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা ঘটে। নিহতদের বেশিরভাগই দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন বলে জানা গেছে।
আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) জানায়, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি এফটি-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান নিয়মিত প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে সোমবার (২১ জুলাই) বেলা ১টা ৬ মিনিটে ঢাকার কুর্মিটোলার বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ঘাঁটি এ কে খন্দকার থেকে উড্ডয়নের পর যান্ত্রিক ত্রুটির সম্মুখীন হয়। দুর্ঘটনা মোকাবিলায় এবং বড় ধরণের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে বিমানের পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম বিমানটিকে ঘনবসতি এলাকা থেকে জনবিরল এলাকায় নিয়ে যাবার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বিমানটি ঢাকার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল এবং কলেজের দোতলা একটি ভবনে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত হয়েছে।
আবার অনেকে এটাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছেও বলে শোনা যাচ্ছে।
এদিকে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবারও উত্তাল হয়ে উঠেছে রাজধানীসহ সারাদেশ। সকাল থেকে বিভিন্ন রকম ঘটনা ঘটেই চলছে। এরমধ্যে রয়েছে, দুই উপদেষ্টা অবরুদ্ধ, ছাত্রদের ৬ দফা দাবি, ছাত্রদের সচিবালয় প্রবেশ, গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এরই মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব সিদ্দিক জোবায়েরকে প্রত্যাহার করেছে। মঙ্গলবার বিকেলে অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য উপদেষ্টা ও জনপ্রশাসন বিষয়ক কমিটির সদস্য সচিব মাহফুজ আলম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক বার্তায় এই তথ্য জানিয়েছেন। এই প্রত্যাহারে কি সমাধান মিলবে?
অতীতের দুর্ঘটনা ও তা থেকে শেখার অভাব
আমাদের দেশের ইতিহাসে এমন অনেক বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে, যা থেকে রাষ্ট্রযন্ত্র শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হয়েছে।
২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি: ঢাকার চকবাজারে নিমতলীর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৭৮ জনের মৃত্যু হয়। অগ্নিকাণ্ডের পর দেখা যায়, রাস্তা সংকীর্ণ, ফায়ার সার্ভিস দ্রুত পৌঁছাতে পারেনি, পর্যাপ্ত পানির উৎস ছিল না। এই অদক্ষতা এবং নগর ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা নিয়ে তখন দেশজুড়ে আলোড়ন ওঠে। কিন্তু অগ্নিকাণ্ডের কারণ ও সমাধান নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপের পরিবর্তে সরকারি ঘোষণা আর শোক বার্তাতেই বিষয়টি শেষ হয়ে যায়।
২০২২ সালের জুন: চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণে ৪৯ জন নিহত হন। রাসায়নিক পদার্থ সংরক্ষণে নিরাপত্তাহীনতা এবং পর্যাপ্ত প্রস্তুতির অভাব এই দুর্ঘটনাকে ভয়াবহ রূপ দেয়। ঘটনার পর একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও তার সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়েছে কি না, সে প্রশ্ন আজও রয়ে গেছে।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল: সাভারে রানা প্লাজা ধ্বস শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের ইতিহাসে ভয়াবহতম শিল্প-দুর্যোগগুলোর একটি। ১৩ মে সোমবার রেশমা বেগমকে উদ্ধারের তিনদিন পর সেনাবাহিনী আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে রানা প্লাজায় উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত করে। বিশ দিনের উদ্ধার তৎপরতায় রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে বের করে আনা হয় ১ হাজার ১২৯টি মৃতদেহ। জীবিত উদ্ধার করা হয় আড়াই হাজারের মতো মানুষ, যাদের অনেকেই চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করে। এই ঘটনা বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের নিরাপত্তাহীনতা এবং দুর্বল শ্রম অধিকারকে নগ্ন করে তুলেছিল।
২০২১ সালের ডিসেম্বর: সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী, অপর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা এবং ত্রুটিপূর্ণ নিরাপত্তা প্রটোকল এ দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে উঠে আসে।
২০২৩ সালের ঘটনা: বঙ্গবাজার অগ্নিকাণ্ডে শত শত দোকান ভস্মীভূত হয়, কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়। নওগাঁর রানীনগরের আগুনে পুড়ে যায় ৫০টিরও বেশি ঘরবাড়ি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া ছিল ধীরগতি, যার ফলে ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়।
২০২৪ সালের ঘটনা: ফেনী-নোয়াখালী অঞ্চলের ভয়াবহ বন্যার সময় সরকারি ত্রাণ কার্যক্রম শুরু হতে বেশ সময় লেগে যায়। সাধারণ জনগণই প্রথমে নিজেদের সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে ত্রাণ ও উদ্ধারকাজে এগিয়ে এসেছে। বন্যার সময় সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম এবং উদ্ধারকাজের ধীরগতির ফলে প্রাণহানি ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে সারাদেশের মানুষের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা দেয়।
উল্লেখিত প্রতিটি ঘটনায় একই ধরণের প্রশাসনিক অদক্ষতা, প্রস্তুতির অভাব এবং জবাবদিহিহীনতা, ক্ষেত্রবিশেষে দায়িত্বহীনতা, আন্তরিকতার ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়।
উত্তরা বিমান দুর্ঘটনা: এক নতুন সতর্কবার্তা
যুদ্ধবিমানগুলো সবচেয়ে উন্নত এবং কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় পরিচালিত হয়। এফ-৭ বিজেআই প্রশিক্ষণ বিমানটি উড্ডয়নের মাত্র ১২ মিনিটের মধ্যে ভেঙে পড়া শুধু প্রযুক্তিগত ত্রুটির ব্যর্থতা নয়, বরং রক্ষণাবেক্ষণ, প্রশিক্ষণ এবং দুর্যোগ মোকাবিলা পরিকল্পনার সামগ্রিক দুর্বলতার প্রতিফলন।
এই ঘটনায় আমরা আবারও দেখেছি, দুর্ঘটনার পর উদ্ধারকাজে ফায়ার সার্ভিস ও জরুরি সেবার ধীরগতি। স্কুল ভবনে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা যথাযথ ছিল না এবং প্রাথমিক চিকিৎসা ও উদ্ধার সমন্বয় ছিল দুর্বল। এক্ষেত্রে অবশ্য গণমাধ্যমকর্মী, উৎসুক জনতা, অতিউৎসাহী ইউটিউবারদের ভিড়ে অভিভাবকগণ, প্রশাসনের লোকজন এবং উদ্ধারকর্মীরা তাদের দায়িত্ব পালনে ঝামেলা পোহাতে হয়েছেন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়: কাগুজে শক্তি, বাস্তবে ব্যর্থতা
বাংলাদেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক বাজেট বিশাল। কিন্তু যেকোনো দুর্ঘটনার পর পরিষ্কার বোঝা যায়, এর প্রভাব মাঠপর্যায়ে অতি সামান্যই। যার মূল কারণগুলো হলো:
দুর্নীতি ও অদক্ষতা: বরাদ্দ অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহার না হওয়া।
অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ: উদ্ধারকর্মীদের দক্ষতা কম এবং আধুনিক সরঞ্জামের অভাব।
প্রতিরোধমূলক সংস্কৃতির অনুপস্থিতি: দুর্ঘটনা ঘটার আগেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার অভ্যাস নেই।
রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ: মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমে রাজনৈতিকীকরণ এবং দলীয় স্বার্থ জড়িত।
মানবিক উদ্যোগ বনাম রাষ্ট্রের অদক্ষতা
বাংলাদেশের দুর্ঘটনার ইতিহাসে বারবার দেখা গেছে যে, সাধারণ জনগণই প্রথমে উদ্ধারকাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে। রানা প্লাজার ধ্বসে হাজারো মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে অংশ নিয়েছে। চকবাজার বা বঙ্গবাজারে স্থানীয়রা নিজেরা পানি ও বালি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের অক্ষমতা জনগণকে অনেক সময় অসহায় করে তোলে। জনমনে তখন বিশাল এক প্রশ্ন জাগে, জনগণের ট্যাক্সের অর্থে পরিচালিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ কী? কেন তারা ব্যর্থ হচ্ছে? এর দায় কার?
দায় এড়ানোর অজুহাত কি রাষ্ট্রীয় শোক?
প্রত্যেকবার বড় দুর্ঘটনায় রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক ঘোষণা করা হয়। শোকের দিনটি শেষ হলে প্রশাসনের মনোযোগও যেন শেষ হয়ে যায়। প্রশ্ন হলো— শোক নয়, কেন দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরোধ পরিকল্পনা কার্যকর করা হয় না? কেন তদন্ত প্রতিবেদনগুলো জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয় না? কেন দায়ীদের বিচার হয় না? কেন?
ইউসুফ আলী বাচ্চু
২২ জুলাই, ২০২৫, 6:56 PM
দুর্ঘটনা ঘটার পরেই সমাধানের কথা আসে, কিন্তু কিছুদিন পরেই আমরা তা ভুলে যাই। সমস্যা থেকেই যায়, আর রাষ্ট্রও পুরনো ঘটনার কথা বেমালুম ভুলে যায়। রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা যেন দায়িত্বের শেষ, কিন্তু যার সন্তান, মা, বাবা, স্বজন হারায়, তারাই কেবল জানে তাদের বেদনা। আবার এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে কেউ কেউ ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টায় থাকে।
প্রতিবার বড় দুর্ঘটনার পর এই একই প্রশ্ন যেন আরও প্রবলভাবে প্রতিধ্বনিত হয়। গত ২১ জুলাই উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনে বিমানবাহিনীর এফ-৭ বিজেআই প্রশিক্ষণ বিমানের বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা এই প্রশ্নকে নতুন করে সামনে এনেছে।
মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি: রোদ ঝলমলে দিনে শোকের ছায়া
দিনটি রোদ ঝলমলে হলেও নেমে আসে শোকের ছায়া। ওইদিন দুপুর ১টা ৬ মিনিটে উড্ডয়ন করা যুদ্ধবিমানটি মাত্র ১২ মিনিটের মাথায় দুর্ঘটনায় পতিত হয়। সংবাদ মাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যাওয়া ছোট ছোট নিষ্পাপ ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির মর্মস্পর্শী চিত্র দেখা যায়।
ঘটনার পর সরকার পরদিন, অর্থাৎ ২২ জুলাই একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে। প্রধান উপদেষ্টা, তিন বাহিনীর প্রধান, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধানরা শোকবার্তা জানিয়েছেন। কিন্তু এই প্রতীকী আনুষ্ঠানিকতা কি আসল সমাধান? জনগণের চোখে এটা মনে হয় যেন দায়িত্ব এড়ানোর এক সহজ কৌশল। এই দুর্ঘটনা আমাদের দেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থার ভয়াবহ দুর্বলতা, আন্তরিকতার অভাব এবং শাসনব্যবস্থার অদক্ষতাকে আবারও নগ্নভাবে প্রকাশ করেছে।
বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় এখনও পর্যন্ত পাইলটসহ ৩১ জন মারা গেছেন। এছাড়া ১৬৫ জন আহত হয়েছেন। সোমবার (২১ জুলাই) দুপুরে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা ঘটে। নিহতদের বেশিরভাগই দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন বলে জানা গেছে।
আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) জানায়, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি এফটি-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান নিয়মিত প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে সোমবার (২১ জুলাই) বেলা ১টা ৬ মিনিটে ঢাকার কুর্মিটোলার বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ঘাঁটি এ কে খন্দকার থেকে উড্ডয়নের পর যান্ত্রিক ত্রুটির সম্মুখীন হয়। দুর্ঘটনা মোকাবিলায় এবং বড় ধরণের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে বিমানের পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম বিমানটিকে ঘনবসতি এলাকা থেকে জনবিরল এলাকায় নিয়ে যাবার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বিমানটি ঢাকার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল এবং কলেজের দোতলা একটি ভবনে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত হয়েছে।
আবার অনেকে এটাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছেও বলে শোনা যাচ্ছে।
এদিকে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবারও উত্তাল হয়ে উঠেছে রাজধানীসহ সারাদেশ। সকাল থেকে বিভিন্ন রকম ঘটনা ঘটেই চলছে। এরমধ্যে রয়েছে, দুই উপদেষ্টা অবরুদ্ধ, ছাত্রদের ৬ দফা দাবি, ছাত্রদের সচিবালয় প্রবেশ, গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এরই মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব সিদ্দিক জোবায়েরকে প্রত্যাহার করেছে। মঙ্গলবার বিকেলে অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য উপদেষ্টা ও জনপ্রশাসন বিষয়ক কমিটির সদস্য সচিব মাহফুজ আলম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক বার্তায় এই তথ্য জানিয়েছেন। এই প্রত্যাহারে কি সমাধান মিলবে?
অতীতের দুর্ঘটনা ও তা থেকে শেখার অভাব
আমাদের দেশের ইতিহাসে এমন অনেক বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে, যা থেকে রাষ্ট্রযন্ত্র শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হয়েছে।
২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি: ঢাকার চকবাজারে নিমতলীর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৭৮ জনের মৃত্যু হয়। অগ্নিকাণ্ডের পর দেখা যায়, রাস্তা সংকীর্ণ, ফায়ার সার্ভিস দ্রুত পৌঁছাতে পারেনি, পর্যাপ্ত পানির উৎস ছিল না। এই অদক্ষতা এবং নগর ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা নিয়ে তখন দেশজুড়ে আলোড়ন ওঠে। কিন্তু অগ্নিকাণ্ডের কারণ ও সমাধান নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপের পরিবর্তে সরকারি ঘোষণা আর শোক বার্তাতেই বিষয়টি শেষ হয়ে যায়।
২০২২ সালের জুন: চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণে ৪৯ জন নিহত হন। রাসায়নিক পদার্থ সংরক্ষণে নিরাপত্তাহীনতা এবং পর্যাপ্ত প্রস্তুতির অভাব এই দুর্ঘটনাকে ভয়াবহ রূপ দেয়। ঘটনার পর একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও তার সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়েছে কি না, সে প্রশ্ন আজও রয়ে গেছে।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল: সাভারে রানা প্লাজা ধ্বস শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের ইতিহাসে ভয়াবহতম শিল্প-দুর্যোগগুলোর একটি। ১৩ মে সোমবার রেশমা বেগমকে উদ্ধারের তিনদিন পর সেনাবাহিনী আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে রানা প্লাজায় উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত করে। বিশ দিনের উদ্ধার তৎপরতায় রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে বের করে আনা হয় ১ হাজার ১২৯টি মৃতদেহ। জীবিত উদ্ধার করা হয় আড়াই হাজারের মতো মানুষ, যাদের অনেকেই চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করে। এই ঘটনা বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের নিরাপত্তাহীনতা এবং দুর্বল শ্রম অধিকারকে নগ্ন করে তুলেছিল।
২০২১ সালের ডিসেম্বর: সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী, অপর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা এবং ত্রুটিপূর্ণ নিরাপত্তা প্রটোকল এ দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে উঠে আসে।
২০২৩ সালের ঘটনা: বঙ্গবাজার অগ্নিকাণ্ডে শত শত দোকান ভস্মীভূত হয়, কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়। নওগাঁর রানীনগরের আগুনে পুড়ে যায় ৫০টিরও বেশি ঘরবাড়ি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া ছিল ধীরগতি, যার ফলে ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়।
২০২৪ সালের ঘটনা: ফেনী-নোয়াখালী অঞ্চলের ভয়াবহ বন্যার সময় সরকারি ত্রাণ কার্যক্রম শুরু হতে বেশ সময় লেগে যায়। সাধারণ জনগণই প্রথমে নিজেদের সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে ত্রাণ ও উদ্ধারকাজে এগিয়ে এসেছে। বন্যার সময় সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম এবং উদ্ধারকাজের ধীরগতির ফলে প্রাণহানি ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে সারাদেশের মানুষের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা দেয়।
উল্লেখিত প্রতিটি ঘটনায় একই ধরণের প্রশাসনিক অদক্ষতা, প্রস্তুতির অভাব এবং জবাবদিহিহীনতা, ক্ষেত্রবিশেষে দায়িত্বহীনতা, আন্তরিকতার ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়।
উত্তরা বিমান দুর্ঘটনা: এক নতুন সতর্কবার্তা
যুদ্ধবিমানগুলো সবচেয়ে উন্নত এবং কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় পরিচালিত হয়। এফ-৭ বিজেআই প্রশিক্ষণ বিমানটি উড্ডয়নের মাত্র ১২ মিনিটের মধ্যে ভেঙে পড়া শুধু প্রযুক্তিগত ত্রুটির ব্যর্থতা নয়, বরং রক্ষণাবেক্ষণ, প্রশিক্ষণ এবং দুর্যোগ মোকাবিলা পরিকল্পনার সামগ্রিক দুর্বলতার প্রতিফলন।
এই ঘটনায় আমরা আবারও দেখেছি, দুর্ঘটনার পর উদ্ধারকাজে ফায়ার সার্ভিস ও জরুরি সেবার ধীরগতি। স্কুল ভবনে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা যথাযথ ছিল না এবং প্রাথমিক চিকিৎসা ও উদ্ধার সমন্বয় ছিল দুর্বল। এক্ষেত্রে অবশ্য গণমাধ্যমকর্মী, উৎসুক জনতা, অতিউৎসাহী ইউটিউবারদের ভিড়ে অভিভাবকগণ, প্রশাসনের লোকজন এবং উদ্ধারকর্মীরা তাদের দায়িত্ব পালনে ঝামেলা পোহাতে হয়েছেন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়: কাগুজে শক্তি, বাস্তবে ব্যর্থতা
বাংলাদেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক বাজেট বিশাল। কিন্তু যেকোনো দুর্ঘটনার পর পরিষ্কার বোঝা যায়, এর প্রভাব মাঠপর্যায়ে অতি সামান্যই। যার মূল কারণগুলো হলো:
দুর্নীতি ও অদক্ষতা: বরাদ্দ অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহার না হওয়া।
অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ: উদ্ধারকর্মীদের দক্ষতা কম এবং আধুনিক সরঞ্জামের অভাব।
প্রতিরোধমূলক সংস্কৃতির অনুপস্থিতি: দুর্ঘটনা ঘটার আগেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার অভ্যাস নেই।
রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ: মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমে রাজনৈতিকীকরণ এবং দলীয় স্বার্থ জড়িত।
মানবিক উদ্যোগ বনাম রাষ্ট্রের অদক্ষতা
বাংলাদেশের দুর্ঘটনার ইতিহাসে বারবার দেখা গেছে যে, সাধারণ জনগণই প্রথমে উদ্ধারকাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে। রানা প্লাজার ধ্বসে হাজারো মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে অংশ নিয়েছে। চকবাজার বা বঙ্গবাজারে স্থানীয়রা নিজেরা পানি ও বালি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের অক্ষমতা জনগণকে অনেক সময় অসহায় করে তোলে। জনমনে তখন বিশাল এক প্রশ্ন জাগে, জনগণের ট্যাক্সের অর্থে পরিচালিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ কী? কেন তারা ব্যর্থ হচ্ছে? এর দায় কার?
দায় এড়ানোর অজুহাত কি রাষ্ট্রীয় শোক?
প্রত্যেকবার বড় দুর্ঘটনায় রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক ঘোষণা করা হয়। শোকের দিনটি শেষ হলে প্রশাসনের মনোযোগও যেন শেষ হয়ে যায়। প্রশ্ন হলো— শোক নয়, কেন দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরোধ পরিকল্পনা কার্যকর করা হয় না? কেন তদন্ত প্রতিবেদনগুলো জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয় না? কেন দায়ীদের বিচার হয় না? কেন?