শাকিলা ইসলাম
২২ জুলাই, ২০২৫, 4:25 PM
রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি ভবনে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ভয়াবহ দুর্ঘটনায় দেশজুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। এই মর্মান্তিক ঘটনায় পাইলটসহ এ পর্যন্ত ৩১ জন নিহত হয়েছেন এবং ১৬৫ জন আহত হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। নিহতদের বেশিরভাগই দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন, যাদের মধ্যে ৯-১৪ বছর বয়সী শিশুরাই ছিল প্রধান। বেশ কিছু মরদেহ এখনও শনাক্ত করা যায়নি। এমন হৃদয়বিদারক পরিস্থিতির কারণে আজ মঙ্গলবার (২২ জুলাই) সারা দেশে রাষ্ট্রীয় শোক পালিত হচ্ছে।
বিধ্বস্ত বিমানের ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা মরদেহ উদ্ধারের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
দুর্ঘটনার বিস্তারিত
আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) জানায়, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি এফটি-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান নিয়মিত প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে সোমবার (২১ জুলাই) বেলা ১টা ৬ মিনিটে ঢাকার কুর্মিটোলার বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ঘাঁটি এ কে খন্দকার থেকে উড্ডয়নের পর যান্ত্রিক ত্রুটির সম্মুখীন হয়। দুর্ঘটনা মোকাবিলায় এবং বড় ধরণের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে বিমানের পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম বিমানটিকে ঘনবসতি এলাকা থেকে জনবিরল এলাকায় নিয়ে যাবার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বিমানটি ঢাকার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল এবং কলেজের দোতলা একটি ভবনে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত হয়। এই ঘটনায় বিমানের পাইলটও মারা গেছেন।
দেশব্যাপী রাষ্ট্রীয় শোক পালন
উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনায় সারা দেশে আজ মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় শোক উপলক্ষে আজ দেশের সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সরকারি-বেসরকারি ভবন ও বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোয় জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছে।
নিহত ব্যক্তিদের আত্মার মাগফিরাত ও আহত ব্যক্তিদের সুস্থতা কামনায় আজ দেশের সব মসজিদে বাদ জোহর বিশেষ দোয়া অনুষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়াও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বিশেষ প্রার্থনা আয়োজনের কথা রয়েছে।
এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত ও শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ
দিনভর লাশের বোঝা টানতে হচ্ছে পুরো জাতিকে। ছোট ছোট শিশুদের এমন করুণ মৃত্যুতে স্তব্ধ পুরো দেশ। এই প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল আজকের এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত করার। কারণ ছোট ভাইবোন হারানোর কষ্ট আর ট্রমার মধ্যে কেউ পরীক্ষায় বসতে রাজি ছিলেন না। বিকেলের পর থেকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরীক্ষা স্থগিত করার দাবি জোরালো হয়। রাত পর্যন্ত সিদ্ধান্ত না আসায় শুরু হয় সমালোচনা ও প্রতিবাদ। কেউ কেউ শিক্ষা উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করেও শাহবাগ অবরোধের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। রাত যত গভীর হচ্ছিল, ক্ষোভ ততই বাড়ছিল। শিক্ষার্থীদের মধ্যে থাকা এই ক্ষোভ অভিভাবক এবং সাধারণ মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। এরপর রাত ৩টার দিকে অবশেষে আজকের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা স্থগিতের ঘোষণা আসে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শোকের মাতম
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘প্রে ফর মেইলস্টোন’ (Pray for Milestone) শিরোনামে হাজারো পোস্ট ছড়িয়ে পড়েছে। কলেজের শিক্ষার্থী, সাবেক শিক্ষার্থী এবং সাধারণ মানুষ নিহতদের স্মরণে প্রোফাইল ছবি পরিবর্তন, আবেগঘন স্ট্যাটাস ও শোকবার্তা প্রকাশ করেন। এছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কালো ব্যাজের ছবি প্রকাশ করে শোকের কথা জানায়। কেউ কেউ ট্রমা কাটিয়ে উঠতে না পারার অসহায়ত্বের কথাও প্রকাশ করেন। কেউ কেউ লিখেছেন, এই দুর্ঘটনা শুধু কয়েকটি প্রাণের মৃত্যু নয়, এটি অসংখ্য পরিবারে স্থায়ী শূন্যতা তৈরি করে দিল। যারা প্রিয়জনদের হাসিমুখে বিদায় জানিয়েছিল, তারা আর কখনোই তাদের ফিরে পাবে না। স্বপ্ন, আশা আর ভালোবাসা সবকিছু থেমে গেল কয়েক সেকেন্ডের বিভীষিকায়।
একজন লিখেছেন, "কত আদরে, যতনে স্কুলে পাঠানো শিশুগুলো এখন পুড়ে ক্ষত-বিক্ষত। কতগুলো কঁচিপ্রাণ ঝরে গেলো, সহ্য করার মতো হৃদয়বিদারক দৃশ্য। আল্লাহ সবাইকে হেফাজত করুন। মা-বাবাদের ধৈর্য ধারণ করার তৌফিক দাও আল্লাহ। দূর থেকে শুধু দোয়াটুকুই করতে পারি। আসুন, বেশি বেশি দোয়া করি সবাই মিলে।"
সিয়াম নামে একজন ব্যবহারকারী লিখেছেন, "শিশুগুলো জানতো না, আজই তাদের জীবনের শেষ সকাল। বাবা-মায়েরাও বুঝতে পারেননি, শেষবারের মতো ব্যাগটা গুছিয়ে দিচ্ছেন। আকাশে ছিল রোদের আড়ালে লুকানো অশ্রুবর্ষা— নেমে এলো এক চিরকালীন বিদায় নিয়ে।"
স্কুলে অনুপস্থিতি ও অভিভাবকদের উদ্বেগ
সোমবারের মর্মান্তিক ঘটনার পর আজ মঙ্গলবার অনেক অভিভাবকই নিজের সন্তানকে স্কুলে পাঠাননি। অজানা এক ভয় অথবা ট্রমার কারণে অভিভাবকরা স্কুলে না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন বলে জানা গেছে। ফেসবুকে একজন অভিভাবক লিখেছেন, "আজকে আমি আমার দুই ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠাইনি, বুকের সন্তান বুকেই থাক।"
ইমতিয়াজ আহমেদ শুভ নামে একজন লিখেছেন, "আজকে আমি আমার মেয়েকে তার স্কুলে যেতে দেই নাই। কিচ্ছু ভালো লাগতেছে না, কাউকে নিজের মনের অবস্থা বুঝাতেও পারছি না।"
তাবাসসুম মেহনাজ নামে একজন অভিভাবক লিখেছেন, "রূপকথার সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা আগে নিজের বাসা এরপর স্কুল (এভাবেই মনকে সান্ত্বনা দিয়ে আসছি)। রূপকথাকে আমি স্কুলে নিয়ে গিয়েছি ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত। বাসা থেকে ওকে নিয়ে বের হওয়ার পর মনে হতো কতক্ষণে পৌঁছাবো। স্কুল গেটে ঢুকিয়ে দেওয়ার পরই শান্তি পেতাম। ভাবতাম, এবার আমার বাচ্চা নিরাপদ। যদিও তা কিন্তু নয়। কিন্তু মনকে প্রবোধ দিতাম। আমার বাসা থেকে ওর স্কুলে হেঁটে যেতে মিনিট বিশেক লাগে। কিন্তু এই সময়টা আমি ভীষণ টেনশনে থাকি। আমি দুশ্চিন্তায় থাকি যতক্ষণ না 'ও' বাড়ি ফেরে। এত দুশ্চিন্তা নেওয়া যায় বলেন? কোথাও কোনও নিরাপত্তা নাই। তাও মনকে প্রবোধ দেই, বাচ্চা নিরাপদে আছে। আমার সন্তানের সোনা মাখা মুখ দেখতে দেখতে আর গতকালের ছোট প্রাণগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে রাত কেটে গেছে। সন্তান হারা মা-বাবাগুলো আজ কী পরিমাণ কষ্টে যে আছে! আর যাদের বাচ্চা হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে, তাদের মানসিক অবস্থার কথা আমরা কেউ বুঝবো না। আল্লাহ, তুমি শক্তি দাও তাদের এই কষ্ট সইবার। আজ রূপকথাকে স্কুলে যেতে দেইনি। বাচ্চাটা আমার বুকে থাক।"
মাইলস্টোন শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ও অন্তর্বর্তী সরকারের আশ্বাস
মঙ্গলবার ছয় দফা দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপ করতে গেলে স্কুলের ৫ নম্বর ভবনে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সি আর আবরার এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। শিক্ষার্থীদের দাবিগুলোর মধ্যে ছিল: নিহতদের সঠিক নাম ও তথ্য প্রকাশ, আহতদের সম্পূর্ণ ও নির্ভুল তালিকা প্রকাশ, শিক্ষকদের গায়ে সেনাবাহিনীর সদস্যদের হাত তোলার জঘন্য ঘটনার জন্য জনসমক্ষে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়া, নিহত প্রতিটি শিক্ষার্থীর পরিবারকে বিমানবাহিনীর পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ প্রদান, বিমানবাহিনীর ব্যবহৃত ঝুঁকিপূর্ণ ও পুরনো প্লেনগুলো বাতিল করে আধুনিক প্লেন চালু করা, এবং বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ পদ্ধতি ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিবর্তন করে আরও মানবিক ও নিরাপদ ব্যবস্থা চালু করা। পরে দুপুরে লিখিত আশ্বাসে অবরোধ তুলে নেন শিক্ষার্থীরা।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো যৌক্তিক বলে মনে করা হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে উপস্থিত হয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেন শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার, আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। আলোচনা শেষে উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের বলেন, "মাইলস্টোন স্কুলে একটি তথ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এতে নিহত ও আহতের তথ্য থাকছে। কেউ নিখোঁজ থাকলে সে তথ্য থাকছে। এখান থেকে তথ্য নিয়মিত হালনাগাদ করা হচ্ছে। নিহত ও আহত পরিবারের ক্ষতিপূরণ, পুনর্বাসন এবং ট্রমা ম্যানেজমেন্ট সাপোর্টের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।"
জনগণের ভিড় নিয়ন্ত্রণের সময় সেনাবাহিনীর কর্তব্য পালনকালে কয়েকজন সেনাসদস্য কর্তৃক শিক্ষার্থীদের ওপর মারধরের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষ থেকে দুঃখপ্রকাশ করা হয়েছে এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সেনা কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে বলে তিনি জানান।
জনবহুল এলাকায় প্রশিক্ষণ বিমান না চালানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য বিমানবাহিনীকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হবে বলেও আইন উপদেষ্টা শিক্ষার্থীদের জানান।
শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার শিক্ষার্থীদের বলেন, আগামী ২৪ জুলাই অনুষ্ঠিতব্য এইচএসসি পরীক্ষার তারিখ নিয়মিত পরীক্ষা শেষে ঘোষণা করা হবে।
নিহত শিক্ষার্থীদের কবর সংরক্ষণের উদ্যোগ
প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনায় নিহতদের কবরস্থানের জন্য মাইলস্টোন স্কুলের সন্নিকটে উত্তরা ১২ নম্বরের সিটি করপোরেশনের কবরস্থানে জায়গা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। পরবর্তীতে এই কবরস্থান তাদের স্মৃতি রক্ষার্থে সংরক্ষণ করা হবে বলে জানিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং।
শাকিলা ইসলাম
২২ জুলাই, ২০২৫, 4:25 PM
রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি ভবনে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ভয়াবহ দুর্ঘটনায় দেশজুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। এই মর্মান্তিক ঘটনায় পাইলটসহ এ পর্যন্ত ৩১ জন নিহত হয়েছেন এবং ১৬৫ জন আহত হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। নিহতদের বেশিরভাগই দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন, যাদের মধ্যে ৯-১৪ বছর বয়সী শিশুরাই ছিল প্রধান। বেশ কিছু মরদেহ এখনও শনাক্ত করা যায়নি। এমন হৃদয়বিদারক পরিস্থিতির কারণে আজ মঙ্গলবার (২২ জুলাই) সারা দেশে রাষ্ট্রীয় শোক পালিত হচ্ছে।
বিধ্বস্ত বিমানের ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা মরদেহ উদ্ধারের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
দুর্ঘটনার বিস্তারিত
আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) জানায়, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি এফটি-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান নিয়মিত প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে সোমবার (২১ জুলাই) বেলা ১টা ৬ মিনিটে ঢাকার কুর্মিটোলার বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ঘাঁটি এ কে খন্দকার থেকে উড্ডয়নের পর যান্ত্রিক ত্রুটির সম্মুখীন হয়। দুর্ঘটনা মোকাবিলায় এবং বড় ধরণের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে বিমানের পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম বিমানটিকে ঘনবসতি এলাকা থেকে জনবিরল এলাকায় নিয়ে যাবার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বিমানটি ঢাকার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল এবং কলেজের দোতলা একটি ভবনে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত হয়। এই ঘটনায় বিমানের পাইলটও মারা গেছেন।
দেশব্যাপী রাষ্ট্রীয় শোক পালন
উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনায় সারা দেশে আজ মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় শোক উপলক্ষে আজ দেশের সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সরকারি-বেসরকারি ভবন ও বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোয় জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছে।
নিহত ব্যক্তিদের আত্মার মাগফিরাত ও আহত ব্যক্তিদের সুস্থতা কামনায় আজ দেশের সব মসজিদে বাদ জোহর বিশেষ দোয়া অনুষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়াও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বিশেষ প্রার্থনা আয়োজনের কথা রয়েছে।
এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত ও শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ
দিনভর লাশের বোঝা টানতে হচ্ছে পুরো জাতিকে। ছোট ছোট শিশুদের এমন করুণ মৃত্যুতে স্তব্ধ পুরো দেশ। এই প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল আজকের এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত করার। কারণ ছোট ভাইবোন হারানোর কষ্ট আর ট্রমার মধ্যে কেউ পরীক্ষায় বসতে রাজি ছিলেন না। বিকেলের পর থেকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরীক্ষা স্থগিত করার দাবি জোরালো হয়। রাত পর্যন্ত সিদ্ধান্ত না আসায় শুরু হয় সমালোচনা ও প্রতিবাদ। কেউ কেউ শিক্ষা উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করেও শাহবাগ অবরোধের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। রাত যত গভীর হচ্ছিল, ক্ষোভ ততই বাড়ছিল। শিক্ষার্থীদের মধ্যে থাকা এই ক্ষোভ অভিভাবক এবং সাধারণ মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। এরপর রাত ৩টার দিকে অবশেষে আজকের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা স্থগিতের ঘোষণা আসে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শোকের মাতম
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘প্রে ফর মেইলস্টোন’ (Pray for Milestone) শিরোনামে হাজারো পোস্ট ছড়িয়ে পড়েছে। কলেজের শিক্ষার্থী, সাবেক শিক্ষার্থী এবং সাধারণ মানুষ নিহতদের স্মরণে প্রোফাইল ছবি পরিবর্তন, আবেগঘন স্ট্যাটাস ও শোকবার্তা প্রকাশ করেন। এছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কালো ব্যাজের ছবি প্রকাশ করে শোকের কথা জানায়। কেউ কেউ ট্রমা কাটিয়ে উঠতে না পারার অসহায়ত্বের কথাও প্রকাশ করেন। কেউ কেউ লিখেছেন, এই দুর্ঘটনা শুধু কয়েকটি প্রাণের মৃত্যু নয়, এটি অসংখ্য পরিবারে স্থায়ী শূন্যতা তৈরি করে দিল। যারা প্রিয়জনদের হাসিমুখে বিদায় জানিয়েছিল, তারা আর কখনোই তাদের ফিরে পাবে না। স্বপ্ন, আশা আর ভালোবাসা সবকিছু থেমে গেল কয়েক সেকেন্ডের বিভীষিকায়।
একজন লিখেছেন, "কত আদরে, যতনে স্কুলে পাঠানো শিশুগুলো এখন পুড়ে ক্ষত-বিক্ষত। কতগুলো কঁচিপ্রাণ ঝরে গেলো, সহ্য করার মতো হৃদয়বিদারক দৃশ্য। আল্লাহ সবাইকে হেফাজত করুন। মা-বাবাদের ধৈর্য ধারণ করার তৌফিক দাও আল্লাহ। দূর থেকে শুধু দোয়াটুকুই করতে পারি। আসুন, বেশি বেশি দোয়া করি সবাই মিলে।"
সিয়াম নামে একজন ব্যবহারকারী লিখেছেন, "শিশুগুলো জানতো না, আজই তাদের জীবনের শেষ সকাল। বাবা-মায়েরাও বুঝতে পারেননি, শেষবারের মতো ব্যাগটা গুছিয়ে দিচ্ছেন। আকাশে ছিল রোদের আড়ালে লুকানো অশ্রুবর্ষা— নেমে এলো এক চিরকালীন বিদায় নিয়ে।"
স্কুলে অনুপস্থিতি ও অভিভাবকদের উদ্বেগ
সোমবারের মর্মান্তিক ঘটনার পর আজ মঙ্গলবার অনেক অভিভাবকই নিজের সন্তানকে স্কুলে পাঠাননি। অজানা এক ভয় অথবা ট্রমার কারণে অভিভাবকরা স্কুলে না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন বলে জানা গেছে। ফেসবুকে একজন অভিভাবক লিখেছেন, "আজকে আমি আমার দুই ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠাইনি, বুকের সন্তান বুকেই থাক।"
ইমতিয়াজ আহমেদ শুভ নামে একজন লিখেছেন, "আজকে আমি আমার মেয়েকে তার স্কুলে যেতে দেই নাই। কিচ্ছু ভালো লাগতেছে না, কাউকে নিজের মনের অবস্থা বুঝাতেও পারছি না।"
তাবাসসুম মেহনাজ নামে একজন অভিভাবক লিখেছেন, "রূপকথার সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা আগে নিজের বাসা এরপর স্কুল (এভাবেই মনকে সান্ত্বনা দিয়ে আসছি)। রূপকথাকে আমি স্কুলে নিয়ে গিয়েছি ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত। বাসা থেকে ওকে নিয়ে বের হওয়ার পর মনে হতো কতক্ষণে পৌঁছাবো। স্কুল গেটে ঢুকিয়ে দেওয়ার পরই শান্তি পেতাম। ভাবতাম, এবার আমার বাচ্চা নিরাপদ। যদিও তা কিন্তু নয়। কিন্তু মনকে প্রবোধ দিতাম। আমার বাসা থেকে ওর স্কুলে হেঁটে যেতে মিনিট বিশেক লাগে। কিন্তু এই সময়টা আমি ভীষণ টেনশনে থাকি। আমি দুশ্চিন্তায় থাকি যতক্ষণ না 'ও' বাড়ি ফেরে। এত দুশ্চিন্তা নেওয়া যায় বলেন? কোথাও কোনও নিরাপত্তা নাই। তাও মনকে প্রবোধ দেই, বাচ্চা নিরাপদে আছে। আমার সন্তানের সোনা মাখা মুখ দেখতে দেখতে আর গতকালের ছোট প্রাণগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে রাত কেটে গেছে। সন্তান হারা মা-বাবাগুলো আজ কী পরিমাণ কষ্টে যে আছে! আর যাদের বাচ্চা হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে, তাদের মানসিক অবস্থার কথা আমরা কেউ বুঝবো না। আল্লাহ, তুমি শক্তি দাও তাদের এই কষ্ট সইবার। আজ রূপকথাকে স্কুলে যেতে দেইনি। বাচ্চাটা আমার বুকে থাক।"
মাইলস্টোন শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ও অন্তর্বর্তী সরকারের আশ্বাস
মঙ্গলবার ছয় দফা দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপ করতে গেলে স্কুলের ৫ নম্বর ভবনে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সি আর আবরার এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। শিক্ষার্থীদের দাবিগুলোর মধ্যে ছিল: নিহতদের সঠিক নাম ও তথ্য প্রকাশ, আহতদের সম্পূর্ণ ও নির্ভুল তালিকা প্রকাশ, শিক্ষকদের গায়ে সেনাবাহিনীর সদস্যদের হাত তোলার জঘন্য ঘটনার জন্য জনসমক্ষে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়া, নিহত প্রতিটি শিক্ষার্থীর পরিবারকে বিমানবাহিনীর পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ প্রদান, বিমানবাহিনীর ব্যবহৃত ঝুঁকিপূর্ণ ও পুরনো প্লেনগুলো বাতিল করে আধুনিক প্লেন চালু করা, এবং বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ পদ্ধতি ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিবর্তন করে আরও মানবিক ও নিরাপদ ব্যবস্থা চালু করা। পরে দুপুরে লিখিত আশ্বাসে অবরোধ তুলে নেন শিক্ষার্থীরা।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো যৌক্তিক বলে মনে করা হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে উপস্থিত হয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেন শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার, আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। আলোচনা শেষে উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের বলেন, "মাইলস্টোন স্কুলে একটি তথ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এতে নিহত ও আহতের তথ্য থাকছে। কেউ নিখোঁজ থাকলে সে তথ্য থাকছে। এখান থেকে তথ্য নিয়মিত হালনাগাদ করা হচ্ছে। নিহত ও আহত পরিবারের ক্ষতিপূরণ, পুনর্বাসন এবং ট্রমা ম্যানেজমেন্ট সাপোর্টের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।"
জনগণের ভিড় নিয়ন্ত্রণের সময় সেনাবাহিনীর কর্তব্য পালনকালে কয়েকজন সেনাসদস্য কর্তৃক শিক্ষার্থীদের ওপর মারধরের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষ থেকে দুঃখপ্রকাশ করা হয়েছে এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সেনা কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে বলে তিনি জানান।
জনবহুল এলাকায় প্রশিক্ষণ বিমান না চালানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য বিমানবাহিনীকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হবে বলেও আইন উপদেষ্টা শিক্ষার্থীদের জানান।
শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার শিক্ষার্থীদের বলেন, আগামী ২৪ জুলাই অনুষ্ঠিতব্য এইচএসসি পরীক্ষার তারিখ নিয়মিত পরীক্ষা শেষে ঘোষণা করা হবে।
নিহত শিক্ষার্থীদের কবর সংরক্ষণের উদ্যোগ
প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনায় নিহতদের কবরস্থানের জন্য মাইলস্টোন স্কুলের সন্নিকটে উত্তরা ১২ নম্বরের সিটি করপোরেশনের কবরস্থানে জায়গা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। পরবর্তীতে এই কবরস্থান তাদের স্মৃতি রক্ষার্থে সংরক্ষণ করা হবে বলে জানিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং।